পর্ব-তিন
সিগন্যাল গ্রিন থাকলে রাস্তা পেরোনোর মধ্যে নিশ্চিন্তি থাকে, কিন্ত্ত মজা থাকে না৷ সব গাড়ি সার সার দাঁড়িয়ে, তোমার যাওয়ার পথ ফাঁকা করে দিয়েছে৷ সেই পথে আপনমনে, ইচ্ছে করলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রাস্তা পার হলেও কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না৷ বেদম বেয়াড়া না হলে কেউ এসে তোমার ঘাড়ে পড়বে না৷ নিরুপদ্রব হাঁটা৷ কিন্ত্ত কখনও একটু দৌড়ে, কখনও বাম হাত বা কখনও ডান হাত তুলে একের পর এক চলন্ত গাড়িকে ডজ করে যখন রাস্তা পেরোনোর মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ নিতে থাকি, তখন বুঝতে পারি এক একটি মৃত্যু পাশ দিয়ে দ্রূত চলে যাচ্ছে৷ আর আমি পরবর্তী মৃত্যুর মোকাবিলায় প্রস্তুত হচ্ছি৷
মৃত্যুকেই অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড় করে রেখে একটার পর একটা এই টপকে যাওয়ার খেলা বেশ নেশা ধরিয়ে দেয়৷ তবে এই খেলায় কেউ সঙ্গে থাকলে আরও মজা হয়৷ তুমি জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে পার, কিন্ত্ত সঙ্গীটি? তার মৃত্যুভয় প্রবল হয়ে ওঠে৷ সে হয়তো নিশ্চিন্ত জীবন চেয়ে হাতটা বাড়িয়েছিল৷ মৃত্যুকে ডজ করার কায়দা বা সাহস কোনওটাই তাকে আনন্দ দেয় না৷ তাই তোমার হাত ধরে রেড সিগন্যালে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়ালেও কখনও কখনও হঠাৎ থমকে যায় সে৷ গাড়িও কষে ব্রেক মারে৷ সঙ্গীটি ভাবে, এবার নির্ঘাত মৃত্যু৷ আর শোনা হবে না সুখস্বপ্নের ফিঙে দোয়েলের কিচিরমিচির ঝগড়া, দেবদেউলের পুজার ঘণ্টাও বুঝি স্তব্ধ হল, সবুজ সোহাগ সাজে আদরের আস্বাদন এ জনমে আর পাওয়া গেল না, প্রেমের ঝরনায় উন্মাদিনী হয়ে ভেসে যাওয়ার স্বাদ থেকে গেল অনাঘ্রাত৷ সব বেকার, বিফল৷ আর আমি ভাবি, গাড়ি চালকও নিশ্চিত জানে, দুটি মৃত্যু একসঙ্গে ঘটে গেলে হাজার বিপদ৷ সবাই জেনে যাবে কে কার হাত ধরেছিল৷ তাছাড়া দুটি পৃথক ঘটনা কখনওই একসঙ্গে, একস্হানে ঘটতে পারে না৷
পৃথক ঘটনা কেন? একজন ভেবেছিল, হাওয়া মোরোগের মুখের চুম্বন নয়, তীরের ফলায় বি হবে, অন্যজন ভেবেছিল, তোমার অমনস্কতার সুযোগে নিরাপদ স্হানে সরিয়ে নেবে নিজের প্রেমের ঘুঁটি৷ হাত ধরাধরিটা তার কাছে ছিল নেহাতই সন্ধিপ্রস্তাব৷ তুমি ভাবছ, সঙ্গে হেঁটে, শত্রুপক্ষের আক্রমণ সামলে কিস্তিমাত করবে৷ সঙ্গীটি ভাবছে কৌশলের সমান্তরাল কোনও নতুন চাল নিয়ে৷ তুমি ভাবছ, বিন্দু জুড়ে জুড়ে একটা আকৃতি দেওয়ার কথা৷ সঙ্গী ভাবছে, দুটো বিন্দু হলেই তো সরলরেখা টানা যায়৷ তুমি ভাবছ প্রাণের সৃষ্টি শুধুই এক ধারণা মাত্র৷ সঙ্গী ভাবছে, এক উজ্জ্বল আলোর বৃত্তে টুপ করে ঢুকে পড়ার কথা৷ তুমি যখন অন্ধকার থেকে আলোর বৃত্তে ফিরতে চাইছ, তোমার হাত ধরে থাকা সঙ্গীর মনে তখন আলো-আঁধারের সীমারেখা নির্ধারণের জটিল অঙ্ক৷ বস্ত্তত কোনও পথেরই নিজস্ব কোনও শুরু কিংবা শেষ বোধহয় নেই৷ সে শুধু উত্স থেকে গন্তব্যের মাঝে যোগসূত্র মাত্র৷ কিন্ত্ত আমাদের এই সাধারণ জীবনে উত্স এবং গন্তব্যের মধ্যে দূরত্ব খুবই কম৷
যে পথ বৃত্তাকার, সে কখনও পথ হতে পারে না৷ তাই আমরা যার হাত ধরেই পথে নামি না কেন, কখনওই ঠিক উত্সে ফেরা হয়ে ওঠে না৷ হয়তো তার কাছাকাছি থাকি, কিন্ত্ত ছুঁতে পারি না৷ কেবলই ধরি ধরি করি…৷ তাই এখন আর দড়িকে সাপ বলে ভুল হয় না, বা সাপকে দড়ি বলে৷ গভীর রাতে সিলিং থেকে একটা দড়ি এসে আটকে যায় গলায়৷ কিন্ত্ত কোনওমতেই পায়ের নিচের টুল সরাতে পারি না৷ ঘুম ভেঙে যায়৷ তাই আয়নার সামনে দাঁড়ালে সেই লোকটার ছবি দেখতে পাই৷ আমার উত্স৷ যার ছায়া বড় হতে হতে ঢেকে ফেলেছে আমাকে৷ এই লোকটা, যে আমারও তিন দশক আগে এমনই লাল সিগন্যালে রাস্তা পেরোনোর সাহস ধরেছিল৷ সেই লোকটা একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল নিজে, অথচ আমায় উঠে যেতে বলল যতদূর পারি নিজে নিজে৷
এই লোকটা বলেছিল, ছায়াকে বড় হতে হয় নিজের থেকে, যাতে অন্য কাউকে ছুঁয়ে ফেলে সেই ছায়া৷ সঙ্গীর হাত ধরে লাল সিগন্যালে রাস্তা পার হতে গিয়ে মালুম হল, বধির শ্রোতার কাছে সুগায়কও বোবা হয়ে যায়৷ রাস্তার মাঝে আমরা দু’জন৷ আমি আগে? না আমার সঙ্গীটি? বাবা যে বলেছিল ছায়া হতে৷ সঙ্গী যে গেয়েছিল ‘হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’৷ আমি অন্তিম মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত হওয়ার আগেই হাত আলগা হল৷ সঙ্গী ততক্ষণে রাস্তার ওপারে৷ হেয়ারপিন মুখে নিয়ে এলোমেলো চুল আবার শক্ত করে বাঁধছে৷ মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে মুছে নিচেছ তাতের আঁচলে৷ আর শর্তহীন সমর্পণ করে, নিরাসক্ত সন্ন্যাসীর মতো তখনও রাস্তার মাঝখানে আমি৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ়৷