অনিমেষকে দেখেছেন কেউ? টুকটুকে ফর্সা, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, লিকলিকে রোগা। কাল রাত আটটা নাগাদ ওই নদী পাড়ের দিকটায় যেতে দেখেছে মাতাল মনোরঞ্জন। তার কথাতে খুব একটা বিশ্বাস হয় না, তবু দেখেছে বলেই তো বলছে। নদী ঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম। বছর খানেক হল বিদ্যুৎ এসেছে। গ্রামের লোকেরাই চাঁদা দিয়ে রাস্তার মোড়ে একটা হ্যালোজেন লাগিয়েছে। বড় মিলমিশ করে থাকে গোটা চল্লিশেক ঘর। ইদানিং কয়েকটি বাড়িতে হরদম টিভিতে সিরিয়াল চলে বটে, কিন্তু ছেলে ছোকরারা এখনও খানিক ব্যাকডেটেড। ওরা বিকালে বল পেটায়, মাঝেমধ্যে চণ্ডী মন্দিরে পালাগানও শোনে। মন্দিরের সামনের মাঠে তিনদিন ধরেই চলছিল তোড়জোড়। পর্দায় দেখা হবে বিশ্বকাপ ফাইনাল। সবাই জড়োও হয়েছিল। মাঠের ঈশান কোণে তিনমুখো উনুন বানানো হয়েছিল। মুরুব্বি সুরেন জেঠুর বাড়ি থেকে আনা পেল্লাই কড়াইয়ে রান্নার আয়োজন। ফাইনাল টসে হার। ধুস। জিতলে আগে ব্যাটিং। সাড়ে তিনশো রান। বুমরার বুমবুম, শামির সুইং। চেনা ছক বানচাল। কিন্তু একি! মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি কাঙারুদের। টসে জিতে ফিল্ডিং। যাকে বলে ধুঁয়াধার শুরু। কিন্তু খেলা খানিক গড়াতেই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। যেন ঝুপ করে যেন নেমে এল অন্ধকার। মিইয়ে গেল সমস্ত তারাবাতি, ফুলঝুরি থেকে শুরু করে আনন্দের তুবড়ি। বাজি হেরে আওয়াজ হারালো সমস্ত বাজি, পটকা।
এই গ্রামের খানিক দূরে পাকা রাস্তা। রাস্তার ওপারে যে গ্রামটি, নামটি ভারী সুন্দর। চন্দনা। সেই গ্রামে একটি শখের যাত্রাদলের মেকাপ করে মতিদা। তার রঙ তুলিতেই বিত্তবান নিবারণবাবু নিমেষেই হয়ে যান পুরাতন ভৃত্য আবার হাঘরে পটলার মাথায় ওঠে শাজাহানের মুকুট। ওসব বাম হাতের খেল মতিদার কাছে। সকাল সকাল সেই মতিদার বাড়িতে হাজির অনিমেষ। এক গালে বিশ্বকাপের ছবি, অন্যগালে জাতীয় পতাকা এঁকে দিয়েছিল মতিদা। হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে সেও হাজির হয়েছিল চণ্ডী মণ্ডপের সামনের মাঠটায়। রাহুলের চার-ছক্কায় উন্মাদের মতো নাচছিল। অনিমেষ সেদিনকার ছেলে। ২০০৩ সালের ফাইনালে জাহিরের মার খাওয়া দেখেনি। শুনেছে সে কথা। আজ তাহলে পাল্টা। অনিমেষ কোহলির খুব ভক্ত। যখন আনুষ্কা কোহলির বিয়ে নিয়ে চর্চা চলছে তখন অনিমেষ সকাল হলেই ছুটতো ওই পাকা রাস্তার দিকে। সেখানে বোর্ডে লাগানো খবরের কাগজে আতিপাতি করে খুঁজত ওদের বিয়ে কতদূর গড়াল। বিরাটের আউট হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকাটা তাল কেটেছিল। তারপর শুরুর সেই আনন্দ খানিক স্তিমিত হলেও, শেষবেলায় ভারতের ২৪০ রানে ভরসা রেখেছিল ওই তরুণ। সবাইকে বলতে শুরু করেছিল, ইডেনের সেমিফাইনালে এর চেয়ে কম রান তাড়া করতে গিয়ে কি অবস্থা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। আর হচ্ছিলও তো তাই। মাটির দিকে বার চারেক মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে বুমরা সেই শুরুর আনন্দ ফিরিয়ে দিয়েছিল অনিমেষকে। তারপর…।
খেলা শেষের আগেই কখন যে চুপিসারে চলে গেল অনিমেষকে দেখার কেউ ছিলও না। খেলা শেষের দশ ওভার আগেই সব ফাঁকা। কড়াইয়ে চাপানো বাঁধাকপি থেকে চোয়া গন্ধ বেরোচ্ছে। কারও নজরে নেই। অনিমেষের কানে এল কেউ বলছেন, টসে হারাটাই কাল হল, কেউ বলছেন, ‘ল অফ অ্যাভারেজ কাজ করল আসল দিনে, কেউ আবার মেজাজ হারিয়ে বললেন, চুপ করোতো, অশ্বিনকে খেলালো না কেন, বলার কিছু নেই। অনিমেষের খোঁজ যখন পড়ল, জাতীয় পতাকাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে তখন সে একা নদী পাড়ে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কালো আকাশে। স্বপ্নভঙ্গে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলে ধুয়ে যাচ্ছে গালে মতিদার এঁকে দেওয়া বিশ্বকাপ। আবেগে ভেসে যাচ্ছে আন্যগালে আঁকা জাতীয় পতাকাও… এ দেশ আমার। এ দেশের সাফল্যে উদ্বাহু হয়ে নাচতে যেমন পারি, ব্যর্থতায় বলতে পারি, জাগো…জাগো…জাগো…। সেই অনিমেষের খোঁজ দিতে পারেন কেউ। প্লিজ।