ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামটা বললেই ‘মাসিমা মালপো খামু’ মনে পড়ে যায়’। সাড়ে চুয়াত্তর ছবির বিক্ষত দৃশ্য। ওরকম প্রাণখোলা সাবলীল অভিনয় খুব কম মানুষই করতে পারেন। আর মনে পড়ে একটা গানের কথা, আমার এই ছোট্ট ঝুরি/ এতে রাম রাবণ আছে/ দেখে যা নিজের চোখে/ হনুমান কেমন নাচে। লোকে বলতেন, কমেডিয়ান। কিন্তু আসলে ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। ভালোবেসে ওনাকে কমেডিয়ান বলে ডাকতেন। ভালোবাসাটা কেমন ছিল তা একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন । একবার ভানু বন্দোপাধ্যায় এক যাত্রায় অভিনয় করতে গেছেন। এক দর্শক চিৎকার করে বলে উঠলেন, ” কি রে ভানু , কেমন আছিস ? ” ভানু তাকে জিজ্ঞেস করলেন , ” আগে কেমন ছিলাম জানোস? ” দর্শক বললেন “না” । ভানুর তখন উত্তর , ” তবে এখন কেমন আছি জানবি কেমনে ? ” এতটাই মানুষের কাছের মানুষ, মনের মানুষ ছিলেন ভানু বন্দোপাধযায়।
ভানুর জন্ম ২৬ আগষ্ট , ১৮২০ তে বিক্রমপুরে। আসল নাম সাম্যময় বন্দোপাধ্যায়। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় সত্যেন বসুর ছাত্র ছিলেন ভানু। কিন্তু হুলিয়া বের হয় তার নামে । ব্রিটিশদের কোনো এক চরকে হত্যার মামলায় তার নাম জড়িয়ে পরে। অগত্যা চলে আসতে হয় কলকাতায়। ভানু বন্দোপাধ্যায়ের বিপ্লবী সত্ত্বার কথা অনেকেরই অজানা। সূর্য সেনের প্রিয় বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন ভানু। শ্রদ্ধা করতেন দীনেশ গুপ্তকেও । বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই আর রিভলভার নিয়ে পাচারও করতেন।
১৯৪৮ সালে ‘জাগরণ’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রথম ছবি। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। বরযাত্রী, পাশের বাড়ি, সাড়ে চুয়াত্তর, আশি তে আসিও না, মিস প্রিয়ংবদা একের পর এক হিট ছবি করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে গেছেন সম্যময় ওরফে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তুলসী চক্রবর্তীকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। একবার তুলসী চক্রবর্তীকে কিছু ছেলে হেনস্থা করায় ভানু রণমূর্তি ধারণ করে তাদের রাস্তার মধ্যেই বেদম প্রহার করেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, জহর রায়, রবি ঘোষ, নৃপতি, নবদ্বীপ হালদার এরা অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় কে ভানুই প্রথম থিয়েটার ও পরে সিনেমা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
অনেকে বলতেন ভানু বাঙাল কথা বলতেন বলে লোক হাসতো। এতে ঘোর আপত্তি ছিল ভানুর। তিনি বলতেন তাহলে কার্নিসগুলোয় লোক গেলে হেসে গড়িয়ে পড়ত। তার অভিনয়ে যে মানুষের হাসি পায় সে কথা বারে বারে বোঝাতে চাইতেন। ইস্টবেঙ্গল আর ইলিশ মাছ ভীষণ প্রিয় ছিল তার। জন্মদিনে ইলিশ মাছ আর পায়েস খেতে খুব ভালোবাসতেন। উত্তম কুমার, সৌমিত্র, দিলীপ রায় এদের আনাগোনা লেগেই থাকত তার বাড়িতে। সাবিত্রী একেবারে ভানুর বাড়ির মেয়ে ছিলেন। আর যোগাযোগ রাখতেন ছবি বিশ্বাস। আসতে না-পারলেও প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নেওয়া চাই-ই চাই। ভানু ও খুব শ্রদ্ধা করতেন এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতাকে।
চার্লি চ্যাপলিন, বস্টার কিটেন দের মতই বাঙালির হৃদয় জুড়ে থাকবেন ভানু, জহর, তুলসী চক্রবর্তী সবাই।