চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে হামলা করার পর ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার মানুষ লাশ হয়ে চলেছে। আর অবিশ্বাস্য এক মানবেতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন গাজার হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ। সেই গাজার শরণার্থী শিবির আল শাতিতে ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া এই তরুণ কবির নাম মোসাব আবু তোহা। আজ তাঁর নাম জানে গোটা দুনিয়া। গাজায় তিনি তাঁর অবরুদ্ধ দিনগুলির কথা লিখেছেন এই ভাবে-
সেদিন রাতে আমরা আমাদের তিনতলা বাড়ির নীচের তলায় বসেছিলাম। একটু পরেই আমার এক ভাই ঘরে এসে ঢুকলো। প্রথমে তাঁর অন্ধকার ঘরে আসাটা ঠিক বুঝতে পারিনি। সেও ঠিক বোঝেনি ঘরে কে কে রয়েছেন। প্রায় কুড়ি ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ ছিল না। আমি একটি চেয়ারে বসে ছিলাম। অনুমান করলাম, আমার ভাই পাশের সোফায় এসে বসলো। হঠাৎ দূরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো। কয়েক কিলোমিটার দূরে বলেই মনে হল। বিকট শব্দের সঙ্গে আলোর ঝলকানিতে বসার ঘরটিতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলো জ্বলে উঠল। আমরা সেই মুহূর্তে একে অপরকে দেখতে পেলাম। আমার ভাই প্রথমে কথা বলেছিল, ‘ও আচ্ছা! তুমি এখানে!’
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামলা শুরু করার পর আমাদের জীবনটা এমনই হয়ে গিয়েছে। আমি পাঁচ দিন আগে শেষ স্নান করেছি আর শেষবার সেলুনে গিয়েছি চার দিন আগে। কোথায় কোথায় যে লুকিয়ে থাকছি, তার ঠিকানা নিজেরই জানা নেই। আমাদের চারপাশে যারা আছেন তাদের কারও জীবন নিরাপদ নয়। আমরা সবাই জানি যে কেউ আর আমরা আগের মতো নেই। প্রতিবেশীরা কেউই নিজের বাড়িতে নেই। সবাই চলে গিয়েছেন জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে। সেই স্কুলগুলি এখন আশ্রয়স্থল। আমিও চেষ্টা করেছিলাম, ওই রকম একটা স্কুলে যদি আশ্রয় পাওয়া যায়। কিন্তু যাওয়ার পর সেখানকার এক কর্মী বললেন, ‘অন্য কোথাও চেষ্টা করুন। এখানে তিন গুণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই’।
অগত্যা বাধ্য হয়েই আমরা নিজের বাড়িতেই থাকবো বলে ঠিক করলাম। কপালে যা আছে তাই হবে বলে আমার মা, বাবা, ভাই আর আমি নিজেদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করলাম। পরের দিন দিন সকাল হতেই আমার দুই বোন সান্দোজ ও সাজা তাঁদের স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হল! সান্দোজের তিনটি ছোট ছেলেমেয়ে। সব থেকে বড়টির বয়স ছয় বছর আর একদম ছোটটির বয়স দু’মাস। আমি আমার বড় ভাগ্নের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার পায়ের তলা কালো হয়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছে। বুঝলাম অতটুকু বাচ্চাকেও অনেক লম্বা রাস্তা হাঁটতে হয়েছে। আমি অন্য কোনো কথায় না গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, যাও, আগে স্নান সেড়ে নাও তারপর… দু’মাস বয়সী ছোট্ট ভাগনি খুক খুক করে কাশছিল। আর আমার বোন সাজা নিঃশব্দে কাঁদছিল। আমি বললাম, কাঁদছ কেন? সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমরা ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ কালো ধোঁয়ায় আমাদের গোটা বাড়িটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর আমাদের গায়ের ওপর ঝুরঝুর করে জানালার কাচ ভেঙে পড়তে শুরু করলো।’
আমাদের বাড়িটিতে এখন দশটি ছোটছোট ছেলেমেয়ে। সবচেয়ে বড় বাচ্চাটি আমার ছেলে, তার বয়স আট আর সবচেয়ে ছোটটি আমাড় ভাগ্নি। কোয়েক ডীণেড় মধ্যেই বোঝা গেল। আমাদের ঘরের খাবার ফুরিয়ে আসছে। আমার মা বাধ্য হয়ে খাদ্যাভ্যাসে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। আমরা এখন দিনে তিনবেলার পরিবর্তে দু’বেলা খাই। আমাদের বাড়ির তিন তলায় আমার একটা লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিতে ঢুকতে এখন খুব খারাপ লাগে। অনেক বই না-পড় রয়ে গিয়েছে। হিসাব করে দেখলাম, যত বই আছে, বছরে যদি ৮০টি বইও পড়ি, তবু সব শেষ করতে ৫৬ বছর সময় লাগবে। হাসি পেল। ৫৬ বছর তো দূরের কথা, ৫৬ মিনিট বেঁচে থাকবো কি না, সে নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ লাশ হয়ে যাচ্ছেন। আমরাও যে কোনো দিন হবো।
২০০৮-৯ সাল নাগাদ ইসরায়েল যখন গাজায় হামলা চালিয়েছিল, তখন আমি আহত হয়েছিলাম। তখন বয়স ছিল ১৬ বছর। সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও ভুলতে পারি নি। সেই স্মৃতি নিয়ে ২০২১ সালে একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেই ইসরায়েল আবার হামলা শুরু করেছে। সব সময় আতঙ্ক তাড়া করছে, তবে কী আবার ২০০৮-৯–এর মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। অনেক দেশ ইসরায়েল থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে। অনেক দেশ অস্ত্র দিয়ে, চিকিৎসাসামগ্রী দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করছে। এসব দেখে আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছে। যেন ইসরায়েলিদের জীবন মহামূল্যবান আর ফিলিস্তিনিদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। তারা সম্ভবত ভুলে গিয়েছে যে আমাদেরও তাদের মতোই দুটো চোখ, দুটো কান আছে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গও একই রকম। আমরাও ভয় পাই, কাঁদি।
যদিও আমি আশা করি, অন্য দেশ ইসরায়েলকে আরও বেশি অস্ত্র দেওয়ার পরিবর্তে এবং গাজায় মানবিক সাহায্য বন্ধ করার পরিবর্তে ফিলিস্তিনের তরুণেরা কেন সীমান্ত পাড়ি দেন, তা নিয়ে ভাববে। তারা যদি বিশ্বাস করে, আমরাও মানুষ এবং আমাদের কোনো আশ্রয় নেই, প্রতিরক্ষা বাহিনী নেই, বিমানবন্দর নেই, সমুদ্রবন্দর নেই, তাহলে তারা আমাদের বাড়ির ওপর বোমা ফেলবেন না।
আমার জন্ম একটি শরণার্থীশিবিরে। কারণ, আমার মা–বাবা তখন উদ্বাস্তু হয়ে ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন আমরা নিজেদের বাড়িতে থাকলেও সেটি যেন একটি জেলখানা। বাড়িটিতে কোনো জানালা নেই, দরজা নেই, আছে কেবল আমন্ত্রণ না পাওয়া অতিথির মতো বোমার ধোঁয়া আছে।