গান্ধিজী যখন নোয়াখালীতে ছিলেন সেই সময়েও হিন্দুদের উপর অত্যাচার বন্ধ ছিল না। শেষমেশ হতাশ হয়েই গান্ধী বলতে বাধ্য হন যে, “হিন্দুরা নোয়াখালী ছাড়ো অথবা মরে যাও”।(নিউইয়র্ক টাইমস, ৮ এপ্রিল, ১৯৪৭) সেই ১৯৪৬ বা পরবর্তী সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে গান্ধির সেই কথাটি যেন ঘুরেফিরে আসা যাওয়া চলছে। যেখানে হিন্দুরা টিকতে পারেনি। হয় নিহত হয়েছে, নয় বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে অথবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে এসে বাঁচার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে গত শতকের চারের দশক থেকে সে দেশে ধারাবাহিকভাবে হিন্দু জনসংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিশেষ করে দুটি দশকে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে সবচেয়ে খুব দ্রুত গতিতে। প্রথম ১৯৪৭ সালের ভারত পাকিস্তান ভাগাভাগির পর এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৪৭ সালে সীমান্ত নির্ধারিত হলেও, সব হিন্দুই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসেননি৷ অনেক পরিবারের এক ভাই চলে এসেছেন, আরেক ভাই রয়ে গিয়েছেন৷ এরপর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ফের অসংখ্য হিন্দু ভিটে মাটির দখল হারিয়ে ভারতে চলে এলেন। অর্থাৎ হিন্দুদের দেশত্যাগের অগস্ত্য যাত্রা চলতেই থাকলো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে হিন্দুদের জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫%, ২০১১ সালে দেখা গেল সেই জনসংখ্যা হয়ে গিয়েছে ৮.৯৬% অর্থাৎ ৩৩% হিন্দু জনসংখ্যা কমে গিয়েছে। এই কমতে থাকা হিন্দু জনসংখ্যা কী প্রমাণ করে না কী পরিমাণ হিন্দু বিদ্বেষ সেখানে বিরাজমান। অন্যভাবেও বলা যায় যে, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কখনো হিন্দুদের সুরক্ষা দেয়নি৷ হিন্দুরা সে দেশে সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভূগেছে৷
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে কিন্তু হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৭০ লক্ষেরও বেশি শরণার্থী ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন। যার ৯৫ শতাংশই ছিলেন বাঙালি হিন্দু। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম জনগণনার সময় মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৯৮ হাজার। তার মধ্যে হিন্দু ১ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৩.৫ শতাংশ। ১৯৬৪ থেকে ২০১৩-র মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ছেড়েছেন। প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার হিন্দু বাংলাদেশ ছাড়েন। সে দেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। সেই নৃশংস গণহত্যার একটি রিপোর্ট দিয়েছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি (১৯৭১, ১ নভেম্বর আমেরিকার সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটিতে) “পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর স্থানীয় আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, টাকাপয়সা লুট করে নেয়, জবর দখল করে তাদের ভূসম্পত্তি। হিন্দুদের নামের তালিকা করে তাদেরকে হত্যা করে, কোথাও কোথাও হিন্দুদের বাড়িতে হলুদ রঙ দিয়ে ‘হিন্দু’ লিখে চিহ্নিত করে রাখে। ইসলামাবাদের সরাসরি নির্দেশে সরকারিভাবে হিন্দুদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ৭১-এ বাংলাদেশে ধর্ষিতাদের মধ্যে ৪২ ভাগ ছিল হিন্দু মহিলা। তাদের মধ্যে ৪৪ ভাগ ছিলেন অবিবাহিত নারী। পাকিস্তানীদের এসব কাজে সাহায্য সহযোগিতা করেছে স্থানীয় দালাল, রাজাকার ও ধর্মীয় নেতারা। (সূত্র- মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস-গোলাম মুরশিদ)
দেশভাগের পর অবিভক্ত পাকিস্তানে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক পরিচয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত। পাকিস্তান জন্মের পর সাংবিধানিকভাবে সেই দেশটির পরিচয় হয় ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা। ফলে হিন্দুরা যে সেই রাষ্ট্রে সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেনি সে কথা বলাই বাহুল্য। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও পাকিস্তান আমলে করা অর্পিত সম্পত্তি আইন বহাল থাকে, যা ছিল বৈষম্যমূলক। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থায়িত্ব ছিল খুব সামান্য সময়ের জন্য। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশে পরিণত হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভের অন্যতম উপাদান ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে সংবিধানকে পঞ্চমবারের মত সংশোধন করে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের মুখবন্ধে দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম যুক্ত করে দেন। পরবর্তীতে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি সংবিধানের ৮ম সংশোধনীতে আর্টিকেল ২(ক) ধারা যুক্ত করে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদায় বহাল রাখেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কারণে অন্যান্য ধর্মগুলির চর্চা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় সেই ধর্মের মানুষরা হয়ে যায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এর আগে ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার কিছু বৈষম্যমূলক আইন তৈরি করেছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সবকটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশ দেয় হিন্দুরা যাতে তাদের ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে না পারে এবং ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুদেরকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার কারণে হিন্দুদের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের সময় হিন্দুদের উপর সংঘবদ্ধ হামলা হয়ে দাঁড়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর সুযোগ। এমনকি ভারতে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে বাংলা দেশের মুসলিম জনতা যে প্রতিবাদ মিছিল বের করে সেই প্রতিবাদী মিছিল চিল আসলে ছিল প্রতিটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার হিন্দুদের বাড়িঘর লুট, অগ্নিসংযোগ, মন্দির ভাঙা। আর পুলিশের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। সেই সব সন্ত্রাস ও হিন্দু হত্যার খতিয়ান কোনোদিন প্রকাশিত হবেনা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর বিএনপি সমর্থকরা সারাদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১৫০ দিন ধরে হিন্দুদের উপর হামলা চালায়। বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ১৮০০০ বড় ধরণের অপরাধের প্রতিবেদন পেশ করেন। তখন সহস্রাধিক হিন্দু মহিলা ধর্ষণের শিকার হন যার মধ্যে ২০০ জনকে গণধর্ষণ করা হয়।
(চলবে)