বসন্ত কুমার শিব শংকর পাড়ুকোন! নামটা শুধু বার্থ সার্টিফিকেটেই থেকে গিয়েছে। সেলুলয়েডের পর্দার গুরু দত্ত হয়েই স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গিয়েছে তার কীর্তি। চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা গুরু দত্ত ভারতের প্রথম পরিচালক যিনি সিনেমাস্কোপে শুট করেছিলেন, সেই ষাটের দশকের শুরুতে। বাকি পরিচয়ের পাশাপাশি অভিনয়ের জগতেও গুরু দত্ত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ২০১০ সালে সিএনএনের ‘সর্বকালের সেরা ২৫ এশীয় অভিনেতার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। বেঙ্গালুরুতে জন্ম হলেও কলকাতার ভবানীপুরে শৈশব কাটে তাঁর। সেখানেই শৈশব-কৈশোর কাটানোর ফলে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করতেন তিনি। বাঙালিদের মতোই বাংলা বলতে পারতেন। বাংলা ও বাঙালির প্রতি টান থেকেই আসল নাম সরিয়ে বাংলা নাম গ্রহণ করে হয়ে বসন্ত কুমার থেকে হয়ে গেলেন গুরু দত্ত।

পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে মেট্রিক পাশের পর আর কলেজে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ওই সময় উদয় শংকর একটি শোর জন্য কলকাতায় এলে ঘটনাচক্রে তার দলে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। উদয় শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার থেকে গুরুকে বার করে দেওয়া হয় মহিলাঘটিত কারণে, যা ছিল গুরুর চরিত্রের দোষ। ডান্স আকাডেমির এক মহিলা নৃত্যশিল্পীকে নিয়ে গুরু পালিয়ে যাবার ছক কষেন। ব্যাপারটা জানাজানি হতেই গুরুকে সরে আসতে হয় আকাডেমি থেকে। তিনি কাজ নেন টেলিফোন অপারেটরের। কিন্তু সৃষ্টিশীল গুরুর বেশিদিন মন টেঁকেনি সে কাজে। অতঃপর মামার সাহায্যে তিন বছরের চুক্তিতে যোগ দেন প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির কাজে। এখানেই তাঁর জীবনের বাঁকবদল ঘটে। প্রভাত ফিল্ম কোম্পানিতে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় দেব আনন্দের। জীবনের শেষদিন অবধি গুরুর সঙ্গে দেবের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। এই ফিল্ম কোম্পানিতে তৎকালীন পরিচালক অমিয় চক্রবর্তী ও জ্ঞান মুখার্জির সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান, পরিচালনার পাঠ শেখেন এখানেই।


এখান থেকেই মূলত সিনেমার প্রতি ভালোবাসা শুরু হয়। এমনকি চলচ্চিত্র জগতে তিনি নৃত্য পরিচালক হিসেবেই যাত্রা শুরু করেন পুনের প্রভাত ফিল্ম স্টুডিওর মাধ্যমে। আর এখানে কাজ করার সময়ই ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা দেবানন্দের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্ব এতটাই গভীর হয় যে, দেব আনন্দ তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ‘আমার প্রযোজিত সিনেমার পরিচালক হিসেবে কাজ করবে তুমি’। সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন দেব আনন্দ। তার প্রযোজিত ‘বাজি সিনেমায় পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন গুরু দত্ত। অন্যদিকে নিজের পরিচালিত সিনেমায় নায়ক হবেন দেব আনন্দ এই ওয়াদাও রেখেছিলেন গুরু দত্ত। তবে বন্ধুকে নায়ক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেও নিজের প্রযোজিত ‘সিআইডি’নানা কারণে পরিচালনা করতে পারেননি গুরু দত্ত। পরবর্তীতে পরিচালনা করেন রাজ খোসলা।

সেই পঞ্চাশের দশকে চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনার মাধ্যমে গুরু দত্ত ভারতীয় চলচ্চিত্রে আলাদা একটা জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা সব ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন সফল। গুরু দত্ত পরিচালিত ‘পিয়াসা, ‘কাগজ কে ফুল’ সিনেমা দুটিকে বলা হয় বলিউডের শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সৃষ্টি। গুরু দত্ত পরিচালিত ছবির মধ্যে রয়েছে বাজি, বাজ, পিয়াসা, আর পার, জাল, কাগজ কে ফুল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ এবং সয়লাব। প্রযোজনা করেন আর পার, সিআইডি, পিয়াসা, গৌরী, কাগজ কে ফুল, চৌধভি কা চান্দ, সাহেব বিবি অউর গোলাম এবং বাহারে ফির ভি আয়েগি। সিনেমার গানেও আলাদা ছাপ রেখে গেছেন। তার নির্মিত বা অভিনীত সিনেমার গান এখনো ভীষণ জনপ্রিয়।
সিনেমার সুবাদে গুরু দত্তর সঙ্গে পরিচয় হয় সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়িকা গীতা রায়ের। এরপর প্রেম, বিয়ে করেন তাঁরা। বিয়ের পর রায় থেকে গীতা দত্ত হিসেবে আবির্ভূত এই গায়িকা। প্রেম করে বিয়ে এবং তাদের কোলজুড়ে তিন সন্তানের আগমন হলেও বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি গুরু-গীতার। চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হলেও ব্যক্তিগত জীবনে গুরু দত্ত ছিলেন ভীষণ খামখেয়ালি ও আবেগপ্রবণ। ধূমপান ও মদ্যপানে আসক্ত ছিলেন তিনি। খ্যাতি, নাম, প্রতিপত্তির সঙ্গে সঙ্গে আসক্তি বেড়েই যাচ্ছিল দিন দিন। এ সবের মাঝেই গুরু দত্তর সঙ্গে পরিচয় হয় ওয়াহিদা রেহমানের। ভারতীয় চলচ্চিত্রে দিলীপ কুমার-মধুবালা, দেব আনন্দ-সুরাইয়ার মতোই আরেক এক ট্রাজিক প্রেম কাহিনি গুরু দত্ত-ওয়াহিদার।
ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে গুরু দত্তের পর্দায় রসায়ন যেমন অনবদ্য ছিল, তেমনই ব্যক্তি জীবনেও তারা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলেন বলে গুঞ্জন শোনা যায়। সুন্দরী ও ধীরস্থির স্বভাবের ওয়াহিদার প্রেমে হাবুডুবু অবস্থা গুরুর। তবে ওয়াহিদার তরফ থেকে কখনোই সে রকম কিছু ছিল না বলে জানা যায়। কিন্তু একতরফা প্রেম বা আসক্তি গুরু দত্তর দাম্পত্য জীবনকে তছনছ করে দেয়। এমনিতেই মদ্যপান নিয়ে ঝামেলা ছিল, এখন ওয়াহিদার সঙ্গে প্রেম— সব মিলিয়ে গীতা দত্ত স্বামীকে ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন। সবকিছুর পরও তাদের বিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু সংসার থেকে আলাদা থাকার বিষয়টি গুরু দত্তের মানসিক টানাপোড়েন আরও বাড়িয়ে দেয়। জানা যায়, তিনি যেমন ওয়াহিদাকে ভালোবাসতেন তেমনই ভালোবাসতেন স্ত্রী গীতাকেও। দুজনের কাউকেই ত্যাগ করতে চাননি।

ব্যক্তিগত জীবনের এই টানাপোড়েনের নেতিবাচক ছাপ পড়ে গুরু দত্তের ক্যারিয়ারে। চলচ্চিত্র জগতের কাহিনি নিয়ে নির্মিত ‘কাগজ কে ফুল’ ব্যবসায়িকভাবে অসফল হয়। এই সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদা-গুরু জুটি। যদিও কাহিনি, পরিচালনা, অভিনয় ও গান সব দিক থেকে সিনেমাটি ছিল এক অসামান্য সৃষ্টি। সিনেমাস্কোপে শুট করেছিলেন ‘কাগজ কে ফুল। মেহবুব স্টুডিওর একটি দেয়াল ভেঙে স্টুডিওর ভেতরের লাইট এবং বাইরের ন্যাচারাল লাইটের সংমিশ্রণে চিত্রায়িত করেছিলেন ক্ল্যাসিক ‘ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যায়া হাসিন সিতাম গানটি। গীতা দত্তের মায়াভরা কণ্ঠে কোনও নাচ বা লিপসিং ছাড়াই ওয়াহিদা রেহমান আর তাঁর চোখের এক্সপ্রেশন এবং নির্মাণের মুনশিয়ানায় গানটিকে কালজয়ী মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের মতোই সিনেমার গল্পে বিবাহিত পরিচালকের সঙ্গে নায়িকার প্রেমের কাহিনি সে সময়ের দর্শক গ্রহণ করতে পারেনি। খ্যাতিমান পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা রাজ কাপুর সেই সময়েই বলেছিলেন যে, ‘কাগজ কে ফুল সময়ের আগেই বানানো হয়েছে। এবং তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় যখন পরবর্তীতে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা লাভ করে এই সিনেমাটি।
‘কাগজ কে ফুল’ সিনেমার ব্যর্থতা আবেগপ্রবণ গুরু দত্তকে আরও বেসামাল করে দিয়েছিল। তবে এরপর ‘চৌধভি কা চান্দ’ সিনেমাতে ওয়াহিদার বিপরীতে আবারও অভিনয় করেন তিনি। মুসলিম পরিবারের গল্প নিয়ে এই সিনেমায় তাদের জুটি ও দক্ষ অভিনয় আলোচনা, প্রশংসা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। তবে গুরু দত্তের সঙ্গে ওয়াহিদার দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় তত দিনে। শুধু ক্যারিয়ারের ব্যস্ততা ও সাফল্যই এই দূরত্বের একমাত্র কারণ ছিল না। ওয়াহিদা তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নায়িকা নন্দার কাছে আক্ষেপ করেছিলেন যে, তিনি সরে গিয়েছিলেন এই কারণে যেন গুরু দত্তের বিবাহিত জীবনে শান্তি ফিরে আসে। কিন্তু পরবর্তীতে বোঝা যায় সেটি ছিল তার ভুল ধারণা। তিনি বুঝতে পারেননি অভিমানী গুরু দত্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন।

টাইম ম্যাগাজিন ঘোষণা করেছিল, সর্বকালের সেরা ১০ রোমান্টিক সিনেমার একটি পিয়াসা। সর্বকালের সেরা ১০০ ছবির তালিকায়ও আছে গুরু দত্তের এই মাস্টারপিস। ছবির প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিলেন গুরু দত্ত। একই সঙ্গে ছবির মুখ্য চরিত্র ট্র্যাজিক কবি বিজয়ের চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। বলা হয়, ছবিতে পাঞ্জাবের কবি, গীতিকার সাহির লুধিয়ানভির জীবন ও লেখিকা অমৃতা প্রীতমের সঙ্গে তার ব্যর্থ প্রেমের ঘটনার ছায়ার আঁধার দেখা যায়। কিন্তু এ ছবিতে বিজয়ের চরিত্রে গুরু দত্ত চেয়েছিলেন দিলীপ কুমারকে। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরু দত্তকেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল।দিলীপ কুমার প্রাথমিকভাবে রাজি হন। তিনি ছবির জন্য দেড় লাখ টাকে পারিশ্রমিকের দাবি করলেন। কিন্তু গুরু দত্ত তাকে পারিশ্রমিক কমাতে অনুরোধ করলেন। কারণ ছবির জন্য এরই মধ্যে কিছু শুটিং করেছিলেন, যেগুলো বাতিল করতে হয়েছে। এই কারণে তার বেশকিছু অর্থ অপচয় হয়ে গেছে। অনুরোধের জবাবে দিলীপ কুমার বললেন টাকা-পয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে। এবার ছবির মুখ্য চরিত্রের জন্য দিলীপ কুমার প্রস্তুত এবং তার ঘনিষ্ঠ ডিস্ট্রিবিউটররা গুরু দত্তের ছবির আর্থিক বিষয়াদির দেখভাল করবেন। সম্ভবত এই শেষের বিষয়টি গুরু দত্তের পছন্দ হয়নি। তিনি দিলীপ কুমারকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে তারও নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউটররা আছেন এবং তিনি তাদের কাছে ‘পিয়াসা’ নিয়ে কথা দিয়েছেন। ‘টেন ইয়ারস উইথ গুরু দত্ত’ বইয়ে আবরার আলভি বলেছেন, সেদিন গুরু দত্ত দিলীপ কুমারকে বলেন, ‘আমি আপনার কাছে আমার ছবি বিক্রি করতে আসিনি। ছবি বিক্রি আমি নিজেই করতে পারব। আমি আপনার কাছে এসেছি পরিচালক হিসেবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আপনি কাজ করলে আমি ভালো একটা সিনেমা নির্মাণ করতে পারব। আপনার উপস্থিতি ছবিতে বাড়তি মর্যাদা যোগ করবে।’ গুরু দত্তের কথায় সেই সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা দিলীপ কুমার কিছু মনে করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। দিলীপ কুমার গুরু দত্তের সঙ্গে এক সাক্ষাতের কথা পরবর্তী সময়ে আর কোথাও উল্লেখ করেননি। কিন্তু সে সময় দিলীপ কুমার গুরু দত্তকে কথা দিয়েছিলেন যে পরদিন থেকে তিনি শুটিংয়ে হাজির থাকবেন।
পরদিন পিয়াসা ছবির মহরতের জন্য সবাই প্রস্তুত। ছবির পুরো টিম দিলীপ কুমারকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছে। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু দিলীপ কুমারের দেখা নেই। গুরু দত্তের প্রডাকশন কন্ট্রোলার গুরুস্বামী বলেছেন, ‘আমি নিজে গিয়েছিলাম দিলীপকে নিয়ে আসতে, কিন্তু তার বাড়িতে গিয়ে দেখি তিনি নেই।’গুরুর ভাই দেবী দত্ত স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তাকে (দিলীপ কুমার) মহরতের জন্য আসতে হত এপি কার্দার স্টুডিওতে। একই কম্পাউন্ডে ছিল বিআর চোপড়ার (প্রযোজক-পরিচালক) দপ্তর। দিলীপ সেখানে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। বিআর চোপড়া ও গুরু দত্তের মধ্যে একটা নীরব রেষারেষি ছিল। দিলীপ সেখানে বসে বিআর চোপড়া র ছবির ‘নয়া দউর’-এর চিত্রনাট্য নিয়ে আলাপ করছিলেন। অন্যদিকে ‘পিয়াসা’র মহরতের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। গুরু দত্ত এবার সেখানে লোক পাঠালেন দিলীপ কুমারকে নিয়ে আসতে। দিলীপ জানালেন, তিনি ১০ মিনিটের মধ্যে আসছেন।‘ কিন্তু তার পরও দিলীপ কুমার সেখান থেকে উঠলেন না। মধ্যাহ্নভোজের সময় গুরু দত্ত আরো দুজনকে পাঠালেন। বেলা ৩টা নাগাদ গুরু দত্ত নিজেই ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং প্রথম শটও নেওয়া হল।