প্রথম পর্ব                              

দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে সম্ভবত দু ভাগে ভাগ করা যায়। এঁদের এক দল ভূতে বিশ্বাস করেন আর এক দল গলা তুলে এক বাক্যেই বলেন, যে, তাঁরা ওসব গাঁজাখুরিতে মোটে বিশ্বাস করেন না। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মানতেই হবে যে, ভূতের গল্পের গা ছমছমে এক ধরনের টান বোধহয় দুদলের কেউই ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেন না। যদিও এত কিছুর পরেও যারা ভূতে বিশ্বাস করেন না তাঁরা গলা তুলে বলেন, ওসব গালগপ্পো শুনতেই ভালো, তার ওপর জমিয়ে নামা শীতের হাড় হিম করা রাত কিংবা ঝিপঝিপে বৃষ্টির সন্ধ্যে হলে তো কথাই নেই, তবে আদতে ওসব কিন্তু রজ্জুতে সর্পভ্রম ছাড়া কিছুই নয়; আর যাঁরা এসবে বিশ্বাস করেন? তাঁদের তো হেলদোলই নেই। 

এত সমস্ত তর্কবিতর্ক মুচকি হেসে উড়িয়ে দিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূতের গল্পের বরদা চরিত্রটির মতো তাঁদের বক্তব্য : দৃষ্টিবিভ্রম যে একেবারে হয় না তা হয়ত নয়, কিন্তু যা রটে জল-টল বাদ দিয়ে তার অনেকটাই কিন্তু ঘোরতর বাস্তব।এবং আমাদের এই মাটির পৃথিবীতে সেসব সত্যিই ঘটে। যা-ই হোক, অযথা তর্কে জড়িয়ে লাভ নেই, বরং তার চেয়ে এরকম একটা ঘটনায় চলে যাওয়াই বোধহয় ভালো তাই না?

প্রথমটা নাহয় একটু পাহাড়ি অঞ্চলেই যাওয়া যাক চলুন। কালিম্পং। এখানে যাঁরা একবার হলেও এসেছেন তাঁরাই জানেন কালিম্পঙের সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের প্রচুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেকালের সিকিম ও ভূটানি রাজারাজড়ার হাত থেকে ১৮৬৪ নাগাদ অ্যাংলো-ভূটান যুদ্ধের পর ছবির মতো এই অঞ্চলে গোরা সায়েবদের পা পড়ে। ১৮৭০ সাল নাগাদ কালিম্পঙে স্কটিশ মিশনারিদের আনাগোনার শুরু। আস্তে আস্তে তৈরি হতে থাকে স্কুল-টুল ইত্যাদি। ব্রিটিশরা ব্যবসার ধান্দায় থাকত। সেকালে পাটের ব্যবসায় যথেষ্ট নাম-দুর্নাম কুড়িয়েছিল তারা। তো সে যাই হোক, ১৯৩০ নাগাদ এরকমই জনৈক ব্রিটিশ পাটকলের মালিক, জর্জ মর্গ্যান কালিম্পং জায়গাটার প্রেমে পড়ে যান। বয়েস খুব বেশি নয়। তার ওপর সদ্য বিয়ে করেছেন। ফলে, এরকম আবহাওয়া, তার ওপর যেদিকে তাকাও কেবল পাহাড় পাহাড় পাহাড়। তা ছাড়া  কাঞ্চনজঙ্ঘার একদম পরিষ্কার ভিউ। সায়েবের, বিশেষ করে মেম সায়েবের তো বেজায় পছন্দ। কালিম্পঙেই থানা গাড়ার উদ্দেশ্যে শহর থেকে তিন কিমি দূরে এখানকার দুরপিনধারা পাহাড়ের মাথায় ভদ্রলোক জায়গা-জমি কিনে বাড়ি বানালেন। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ি।বাড়ির নাম রাখা হল সায়েবের নামে, মর্গ্যান হাউস

প্রায় ষোলো একর খোলা জমির ওপর বাড়ি। একবার পা রাখলে শহরে ফেরার কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।শুধু তা-ই নয়, লোকে বলে নতুন বিয়ে করে যখন তখন হুটহাট  বউ নিয়ে এখানে চলে আসতেন দুজনে। আর গরম কালে তো কথাই নেই। সেই যে এসে ডেরা নিতেন দুজনে, ফেরার নাম করতেন না।বিরাট বিরাট পার্টি দিতেন। লোকজনে ভরে যেত অত বড় বাড়ি। দিন গেল।সায়েব মেম নিঃসন্তান। দুজনেই দেহ রাখলেন। সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যে ট্রাস্টি খাড়া হল।

 তারপর দেশ স্বাধীন হল।বাড়ি চলে এল সরকারের হাতে। প্ল্যান ছিল হবে সরকারি রেস্ট হাউস। জওহরলাল মারা গেলেন।প্ল্যান বানচাল। সাতের দশকে বাড়ি গেল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে। এককালে উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী, কিশোরকুমার, উৎপল দত্ত, সুনীল দত্ত, নার্গিস প্রমুখের প্রিয় ছুটি কাটানোর এই ঠিক ঠিকানার আসল গল্পটাই কিন্তু এখনো বলা হয়নি। কেবল লোকেই বলে না, অনেকে নাকি দেখেওছেন তেমন তেমন রাতে এ বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ান এক শ্বেতবসনা শ্বেতাঙ্গিনী। বাসিন্দাদের বক্তব্য, ইনি নাকি আসলে লেডি মরগ্যান ছাড়া কেউ নন। জীবনের সবথেকে পছন্দের বাসস্থান ছেড়ে কোথায়ই বা যাবেন বেচারি ! তাই…    
Share.

1 Comment

  1. গেছিলাম ১৮-র ফেব্রুয়ারীতে। ম্যাজিস্ট্রেটদের সৌজন্যে মর্গ্যান হাউসে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগও পেয়েছিলাম। কেয়ারটেকার একজন ঘোড়সওয়ারের কথা বলেছিল, যাকে কখনও কখনও মাঝরাতে “দেখা” যায়।

Leave A Reply

Exit mobile version