রাঢ় বাংলার পূর্ব বর্ধমান জেলার অর্ন্তগত কালনা দু-নম্বর ব্লকের বৈদ্যপুর একটি প্রাচীন গ্রাম।  এলাকায় আছে জমিদার বাড়ি। এছাড়া গ্রামটিকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর মন্দির। বৈদ্যপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত নারকেলডাঙ্গা গ্রাম, মনসা-মঙ্গল কাব্যে এই গ্রামের নাম আছে।  এই গ্রামেই জগৎগৌরী মায়ের মন্দির। লাল রঙের মন্দিরের চূড়া ক্রমশ সরু হয়ে উঠেছে,  তাতে সাপের মূর্তি আঁকা। চূড়ায় ত্রিশূল ও ওঁ দেওয়া আছে। প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকে ডানপাশে দক্ষিণ-মুখী  মায়ের মন্দির। তার সামনে ছ-টি থামের ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া আট-চালা; তার শেষে বলি দেওয়ার জন্য একটি হাঁড়িকাঠ, দক্ষিণে ভোগ রান্নার ঘর ও পশ্চিমে বিশ্রামাগার।

জগৎগৌরী কষ্টি পাথরের মূর্তি। দেবী সিংহের ওপর স্থাপিত পদ্মের ওপরে বাম পা মুড়ে, ডান  পা ঝুলিয়ে বসে। দেবীর কোলে একটি শিশু। মাথার ওপর ছাতার মতো অষ্টনাগ ফণা বিস্তার করে, পদতলে একটি ছিন্ন মুন্ডু।

পদ্মপুরানে জগৎগৌরীর পরিচয় পাওয়া যায়। দেবাদিদেব মহাদেবের কন্যা, ব্রহ্মা নাম রাখেন বিষমুখ, অনেকে বলেন বিষহরি। এই বিষহরি জগতের মঙ্গল করবে বলে তার নাম রাখা হয় জগৎগৌরী। পদ্মবনে পদ্ম পাতায় জন্ম বলে আর এক নাম পদ্মাবতী, নাগলোকে নাম মনসা।

যে মনসা সেই জগৎগৌরী। নারকেলডাঙ্গায় জগৎগৌরীকে মা মনসা ও মা দুর্গা দুই রূপেই দেখা হয়।  এই  দেবীর পূজায় প্রথমে জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্র ও পরে মনসার ধ্যানমন্ত্র পাঠ করা হয়। ‌প্রতিদিন পূজা ও ভোগ দেওয়া হয়।

সব মন্দিরের মতো নারকেলডাঙ্গার মা জগৎগৌরীর পূজা নিয়ে ইতিহাস আছে।বৈদ্যপুরের জমিদার নন্দী বংশের মেজ তরফের এক বাল্য-বিধবা স্বপ্নে মা জগৎগৌরীকে দেখেন নারকেলডাঙ্গার  কচু- বনে। স্বপ্নে দেখা দেবীকে তুলে নিয়ে এসে দুর্গা মন্ডপে রেখে পূজা করা হয়। পরে স্থানান্তরিত করা হয় স্থানীয় তান্ত্রিক শ্রী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে জগৎগৌরী মায়ের মন্দির তৈরি করেন।  বর্তমানে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশধরেরা মন্দিরের পূজা করেন। গ্রামের মঙ্গলের জন্য  ফাল্গুন মাস থেকে শ্রাবণ মাস দেবীকে গ্রামে ভ্রমন করানো হয়। মন্দির থেকে কিছুটা দূরে ঝাঁপান তলা, জৈষ্ঠ্য মাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে (দশ হারার পরের পঞ্চমী) ঝাঁপান হয়। আষাঢ় মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ঝাঁপান তলায় জগৎগৌরীর বিশেষ পূজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় মায়ের পূজা করে স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। উৎসবটি ঝাঁপান উৎসব নামে পরিচিত। ঝাঁপান শব্দের অর্থ ডুলি, দেবীকে ডুলিতে বসিয়ে ঘোরানো হয় বলে মনে হয় ঝাঁপান বলা হয়ে থাকে। সে সময় মায়ের পূজা উপলক্ষে ঝাঁপান তলায় মেলা বসে।

এই উৎসবটি এলাকার সবচেয়ে বড় উৎসব, এটি তিন দিন ধরে চলে। ঝাঁপানের আগের দিন রাজবেশ ও অধিবাস হয়। ঝাঁপানের দিন সকালে দেবীকে কচুদহের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় ও রাতে ফিরিয়ে আনা হয়। দূর দূরান্ত থেকে বহু ভক্ত সমাগম হয়। সারাদিন ধরে পূজা পাঠ চলে। মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার জন্য ছাগ-বলি দেয় অনেকে, বহু ছাগ-বলি হয়। এই উৎসবে রাস্তায় নাচ-ঘর বের হয়। গরুর গাড়িতে মঞ্চ সাজিয়ে নানারকম ভাবে সেজে তৎকালীন বিষয়ের ওপর নাচ গান করে। “থাকা” বলে আর এক রকমের মঞ্চ সাজায় বাঁশ আর কঞ্চি দিয়ে সিড়ির মতো করে। “থাকা” সাজানো হয় পৌরাণিক বিষয়ের ওপর। পুতুল সাজিয়ে গান বাজনা করতে করতে আর নাচতে নাচতে ঝাঁপান তলায় আসে। প্রতিটা পাড়া থেকে “থাকা” সাজায়, দুপুরে সারিবদ্ধ ভাবে পরপর সেগুলো সাজিয়ে রাখা হয়। সবথেকে কোন “থাকা”-টি সুন্দর তার বিচার করে সাধারণ মানুষ।ঝাঁপান উৎসবের পরদিন তৃতীয় দিন “পাল্টা পূজা” হয়ে তিনদিনের গ্রাম্য মেলা শেষ হয়।

হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনের যে কোনো লোকাল ট্রেনে বৈঁচি নেমে, স্টেশন থেকে কালনাগামী যেকোনো বাসে বৈদ্যপুরের রথতলা নেমে টোটোতে নারকেলডাঙ্গার জগৎগৌরী মায়ের মন্দির।অথবা, হাওড়া কাটোয়াগামী ট্রেনে কালনা নেমে, বৈঁচিগামী বাসে বৈদ্যপুর রথতলা নেমে টোটোতে জগৎগৌরী মায়ের মন্দির।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version