এক

আমার দাদু বলতেন, বন্ধু হলে ভাল, নয়তো বন্ধু শব্দের পিছনে একটা ক যোগ করিস৷ পড়াশোনার সময় সে ভাবে বুঝতে পারিনি, কিন্ত্ত কাজের জগতে ঢুকে প্রয়াত দাদুর কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচিছ৷ ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করার রাস্তায় না গিয়ে একটা কথা বলেই ফেলা যায়, যতই কবীর সুমন ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা, চাইছি তোমার বন্ধুতা’ নিয়ে গান বাঁধুন, চাইলেই তা পাওয়া যায় না৷ সেক্ষেত্রে অবশ্য চাওয়াটা কেমন তাও দেখতে হবে৷

তোমায় আমি বকব না, তেলের মতো মাখব না, ফুলের মতো পাড়ব না, রুটির মতো সেঁকব না, রাবারের মতো টানব না, আচারের মতো চাখব না, বলার সাহস ধরাটাই কষ্টকর৷ ফলে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, প্রেম থেকে দাবি, দাবি থেকে বিচেছদ এই সহজ সমীকরণের উদাহরণ খুঁজতে খুব কষ্ট হয় না৷ শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ায় তা হল, ধুত্‍ তেরিকা৷ রইল ঝোলা চলল ভোলা৷ সে রকমই এক প্রবাসী বান্ধবীর সঙ্গে একেবারে প্ল্যান করে দেখা হল সেদিন৷ সি লিভস ইন টোকিও৷

ওখানে একটি বিরাট কোম্পানিতে বিরাট কাজ করে বলে শুনেছি৷ জিজ্ঞেস করিনি, কারণ, তার কাজ নিয়ে যা বক্তৃতা দেবে তা আমার জানার বা বোঝার কোনওটারই বিশেষ দরকার নেই৷ কলকাতায় তার প্লেন ল্যান্ড করেছে মাত্র সপ্তাহখানেকের জন্য৷ উঠেছে ধর্মতলার পাঁচতারা হোটেলে৷ সেখানে আমার মতো একমুখ দাড়ি গোঁফ, হাজার কালের কালো ছোপ ছোপ চেহারা বড় বেমানান৷

যাইহোক ধান ভাঙ্গতে শিবের গীত না করে সরাসরি ঘটনাটায় আসি৷ হোটেল থেকেই বোধহয় একটা ঝাঁ চকচকে গাড়ি ডেকে দিয়েছিল৷ সাদা পোশাক টুপি পরা একটা গম্ভীরমুখো লোক কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা রাস্তায় চোখ রেখে গাড়ি চালাচ্ছিল৷ আমাদের গন্তব্য ছিল পার্ক স্ট্রিটের পিটারক্যাট৷ এখানকার চেলো কাবাব নাকি রাহুল গান্ধী পর্যন্ত খেয়ে গিয়েছেন৷ গাড়িটা তখন ঠিক পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে৷ জানালা তোলা৷ আমি বিদেশি পারফিউমের গন্ধ আরও গভীর ভাবে নাকে টানার চেষ্টা করছি৷ এমন সময় গাড়ির জানালায় টোকা৷ কলকাতার প্রান্তিক যিশু দাঁড়িয়ে৷ ময়লা ফ্রক, মাথায় বেশ কয়েকদিনের না আঁচড়ানো চুল৷ না, নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে পড়ছে না৷ পড়লে হয়তো ওই ক্রান্তিবীর সিনেমার ডায়লগটাই দিতাম প্রবাসী বান্ধবীকে৷ ওহ ডার্লিং, ইয়ে হ্যায় ইন্ডিয়া৷ রাস্তায় সাত আট বছরের রোগা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ভাসা ভাসা চোখের কোনও বাচচাকে দেখলে মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়৷ অর্থ যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, অর্থসাহায্য দিয়ে সমস্যার চিরস্হায়ী সমাধান সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস হয় না৷ তবু, সাহায্য আমি করি৷ গাড়ির কাচ নামিয়ে ওই মেয়েটিকে কয়েকটি টাকা দিতে যেতেই ফুঁসে উঠল বান্ধবী৷ আমাকে বলল, এইভাবে টাকা দেওয়ার অভ্যেস ছাড়৷ মেয়েটিকে বলল, আমার বাড়িতে কাজ করতে যাবি? মেয়েটি দুপাশে মাথা নাড়ল৷ তার মানে বলল না৷ সিগন্যাল সবুজ হল৷ গাড়ির কাচ উঠল৷ আমার হাতের টাকা হাতেই রইল৷ দৃশ্যপট থেকে সরে গেল নতুন বছরে খেতে চাওয়া ওই মেয়েটি৷ ওর নাম যদি পাপড়ি হয়, তাহলে বলাই যেত, ‘পাপড়িটা বড় বোকা, হিলতে শেখেনি কষ্ট, কোন আক্কেলে করতে চাইলি মোদের সময় নষ্ট৷’

ফ্লুরিসের টেবিলে যা ঘটল, সেটাই হল আসল কথা৷ আসল তর্ক৷ বান্ধবী বলল, এই কলকাতার রাস্তার ছেয়ে মেয়েরা চাইতে অভ্যস্ত, কাজ করতে নয়৷ দেখলি তো, কাজের কথা বলতে কেমন মাথা নাড়ল৷ আমি বললাম, কেন কাজ করবে? এটা কি ওদের কাজের বয়স? আমার মেয়েটা বা তোর ছেলেটা যদি কিছু কিনতে টাকা চায়, আমরা কি তাদের কাজ করার কথা বলি? নিজের ছেলেমেয়েদের বেলায় চাইল্ড লেবার তত্ত্ব, অন্যের বেলায় সব হাওয়া? আসলে আমাদের মনেই শিশুশ্রমের বীজ লুকিয়ে আছে৷ না হলে, তোর ছেলের সঙ্গে খেলার জন্য যে মেয়েটিকে বাড়িতে এনে রেখেছিস তার বেলা শিশুশ্রম তত্ত্ব কোথায় গেল রে? আমি মনে করি, আমার মেয়েটির বা ছেলেটির হাতে পয়সা দিতে যেমন আমার ভালো লাগে, সেখানে তাকে বাড়ির কাজের প্রস্তাব দিতে পারি না, তেমনই ওই পার্ক স্ট্রিটের মেয়েটির ক্ষেত্রেও৷ তাই কিছু টাকা তার হাতে দিতে চেয়েছিলাম৷ ভিক্ষাবৃত্তি তুলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে, তাতে আমি অন্তত আতঙ্কিত, সে দেশে শিশুশ্রম বাড়বে না তো? কারণ, না খেতে পাওয়া মা-বাবার ছেলেমেয়েরাও তো খেতে পায় না৷ তারা ভিক্ষাবৃত্তি না করে কি আপনার ঘরের বাসন মেজে টাকা উপার্জন করবে? সেটা কি একটা দেশের পক্ষে খুব ভালো বিজ্ঞাপন হবে? বান্ধবীর কাছে উত্তর ছিল না৷ আপনার কাছে আছে?

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version