শেষ কবে এই মাপের একজন সিনেমা নির্মাতা ভারতের মাটিতে পা রেখেছেন? এই প্রশ্ন করলে অনেকে রেনোয়ার কথা বলবেন, অনেকে আবার আন্তোনিওনির কথা বলবেন। কিন্তু তাঁরা কেউই পঁচিশ দিন ধরে ভারতের নানা শহর নিজের ছবিগুলি নিয়ে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছেন নিজের ছবির নির্মাণ-দর্শন নিয়ে, উৎসাহী দর্শকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন? না ঠিক এমনটা এর আগে এদেশে কখনও ঘটেনি। ছবির উৎসব দেশের প্রায় সব শহরেই হয়, কলকাতায় নিয়ম করে হয় কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, সেই মঞ্চে দেশ বিদেশের বহু ছবি-করিয়েরা হাজির হন, কিন্তু তাঁদের আসা-যাওয়া মাথায় রেখেও বলা যায় যে উইম ওয়েন্ডার্স এক জনই। বিশ্বখ্যাত জার্মান চলচ্চিত্রকার ‘কিং অব দ্য রোড: দ্য ইন্ডিয়া ট্যুর’ শিরোনামে ভারত-সফর শুরু গতকাল রবিবার, মুম্বই-তিরুঅনন্তপুরমের পর কলকাতায় পৌঁছান।

নন্দন ১, বসুশ্রী ও পিভিআর-আইনক্স সাউথ সিটি, এই তিনটি প্রেক্ষাগৃহ মিলিয়ে দেখানো হবে পরিচালকের মোট ষোলোটি ছবি। ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুরের নেতৃত্বে যে ভারতীয় সংস্থাটি চলচ্চিত্র ও মুভিং ইমেজের সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে নিবেদিতপ্রাণ, উইম ওয়ান্ডার্সের এই ভারত-সফরের পিছনে তাদের ভূমিকা যারপরনাই। সঙ্গী হয়েছে পরিচালকের নিজস্ব ‘উইম ওয়েন্ডার্স ফাউন্ডেশন’, এবং কলকাতা-পর্বে গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবন কলকাতা। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় প্রথম ছবি প্যারিস, টেক্সাস-এর রেস্টোর্ড ভার্সন, ১৯৮৪-তে যে ছবি কান ফিল্মোৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কার পেয়েছিল, ’৮৫-র বাফটা-তে সেরা পরিচালকের সম্মানও। পরিচালক নিজে হাজির ছিলেন, ছবির শেষে উত্তর দেন দর্শকের নানা প্রশ্নের।

ম্যাক্সমুলার ভবনে ১৭ ফেব্রুয়ারি জি ডি বিড়লা সভাঘরে সন্ধ্যা ৬টা থেকে উইম বললেন ওঁর চলচ্চিত্রযাত্রা নিয়ে, সঙ্গে কথালাপে ছিলে শিবেন্দ্র। ৭৯ বছর বয়সী ওয়েন্ডার্স পাঁচটি শহরের “কিং অফ দ্য রোড – ইন্ডিয়া ট্যুর”-এ বললেন, “বিগত বছরগুলিতে আমার সমস্ত বিশ্ব ভ্রমণে, এটা আশ্চর্যজনক বলে মনে হচ্ছে যে ভারত মানচিত্র থেকে বাদ পড়েছে, কেবল এই কারণে নয় যে এটি এমন একটি দেশ যেখানে অন্বেষণ করার জন্য প্রচুর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং চিত্র রয়েছে, বরং এই কারণেও যে এটি এমন একটি দেশ যেখানে সিনেমা একটি ধর্মের মতো,” মুম্বাইয়ে সম্প্রতি এক আলোচনায়, ওয়েন্ডার্স সত্যজিৎ রায়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “আমি সাবটাইটেল সহ প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় ছবি দেখেছি…. আমি বুঝতে পেরেছি সত্যজিৎ রায় তার প্রজন্মের একজন মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন,” পিটিআই ওয়েন্ডার্সের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে। ১৯৭৩ সালের বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ রায়ের সাথে সাক্ষাতের কথা ওয়েন্ডার্স স্মরণ করেন, যেখানে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশানী সংকেত’ প্রদর্শিত হয়েছিল।

উইম ওয়েন্ডার্স ও তাঁর “প্যারিস, টেক্সাস”
গত শতাব্দীর সত্তর দশকের শুরুর দিকেই জার্মান সিনেমার নব তরঙ্গে হ্যার্জোগ, ফ্যাসবাইন্ডার, শ্লন্ডরফ, ভন ট্রোটা প্রমুখের সঙ্গে উচ্চারিত নাম উইম ওয়েন্ডার্স। জার্মানী হলেও তিনি আমেরিকান সিনেমা এবং সঙ্গীতে প্রবলভাবেই আকৃষ্ট। ওঁর “প্যারিস, টেক্সাস”(১৯৮৪)-এর ট্র্যাভিস(হ্যারি ডিন স্ট্যান্টন)কে দেখে প্রথমে পাগল কিংবা হতাশ অথবা জীবন যুদ্ধে পুরোপুরি হেরে যাওয়া একটি মানুষ মনে হয়। আবার অসুস্থ ট্র্যাভিসকে তাঁর ভাই ওয়াল্ট হেন্ডারসন(ডিন স্টকওয়েল)যখন নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে যেতে যেতে আবার রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করে, কথাই বলতে পারে না। অবশেষে যখন সে কথা বলতে শুরু করে, তখন মনে হয় যেন সে থেমে থেমে এমন একটি জীবনকে একত্রিত করছেন যা তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।

মনে হয় ওয়েন্ডার্স বাস্তবতার একটি আখ্যান আমাদের সামনে তুলে ধরলেও এটি কিন্তু আসলে একটি কল্পকাহিনী, এবং সেটি তাঁর “উইংস অফ ডিজায়ার”-এর মতোই। এই আখ্যানটি অনেকটাই আমেরিকান পৌরাণিক কাহিনীর আদলে বলা এবং আদিম আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে। সেভাবে দেখলে ট্র্যাভিস নামটি কি আমাদের ট্র্যাভিস ম্যাকগির কথা মনে করিয়ে দেয় না, যিনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, তিনি হারিয়ে যাওয়া আত্মাদের উদ্ধার করেন এবং কখনও কখনও তাদের প্রেমে পড়েন। টেক্সাসের পরিবেশ যে ধরনের চিন্তাভাবনার পরিবেশ সৃষ্টি করে “প্যারিস, টেক্সাস”-এ মরুভূমি কিংবা শহর কিন্তু তেমনটা নয় বরং এমন একটি যাত্রা যা একটি থেকে অন্যটিতে যাওয়া এবং সুখকর রূপেই শেষ হওয়া। তবে “প্যারিস, টেক্সাস” তীরের মতো বা সরলরেখায় চলা একটি যাত্রা, যেখানে ট্র্যাভিস তাঁর পরিবারকে খুঁজে পাবে এবং আবার হারাবে।

স্যাম শেপার্ড ও হেলেন ক্যাল্ডওয়েল-এর অনবদ্য চিত্রনাট্যে, ডাচ মাস্টার রবি মুলারের আশ্চর্য আলোকচিত্রে, রাই কুডারের অদ্ভুত সাউন্ডট্র্যাক, তার সঙ্গে হ্যারি ডিন স্ট্যান্টন এবং নাস্তাসজা কিনস্কির অসাধারণ অভিনয়, সব মিলিয়েই ১৯৮৪ সালে উইম ওয়েন্ডার্সের আইকনিক কান বিজয়ী “প্যারিস, টেক্সাস” ৪০ বছর পরেও জাদুমোহে বিপন্ন করে, বিপর্যস্ত করে।