বর্ষায় সমুদ্রে যাওয়া হয়েছে বহুবার, পাহাড় বেড়াতে গিয়ে নানা রকম ঝঞ্ঝাটে পড়েছি জীবনে অনেক। তাই এবার দু’দিনের ছুটিতে বন বাংলোয় থাকার হাতছানিটা উপেক্ষা করতে পারলাম না। সত্যিই একেবারে নতুন এক অভিজ্ঞতা হল এবারের উইক এন্ড টুরে গড়পঞ্চকোটে গিয়ে। সময়টা আগস্ট মাসের শেষের দিকে, ভরা বর্ষায়। আমরা চার বন্ধু ঘুম চোখে ভোরবেলা হাজির শিয়ালদহ স্টেশনে। গন্তব্য আসানসোল। সকাল ৬-৩০ টা নাগাদ একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন আছে যা ১১ টা নাগাদ আসানসোল পৌঁছায়। ভাড়াও কম। ভিড় ততোধিক কম। প্রায় শুয়ে বসেই পৌছে গেলাম আসানসোল।

আসানসোল স্টেশনের বাইরে এসে বুঝলাম এখানে বেশ গরম। তারই মধ্যে আমাদের জয়দীপ, সর্বদা ম্যানেজারের রোল প্লে করা রেল কোম্পানিতে কর্মরত একখান গাড়ি বেশ কম পয়সায় বুক করে ফেলেছে। চা, সিগারেট খেয়ে সবাই হৈ হৈ করে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আসানসোলের জনবহুল রাস্তা শেষ করে বার্নপুর ইস্পাত কারখানাকে ডান হাতে রেখে পুরুলিয়ার রাস্তা ধরল গাড়ি। গাড়ি যত এগোতে লাগলো পরিবর্তন হতে থাকলো দৃশ্যপট। দূরে দেহাতি গ্রাম, তালগাছের সারি, গরু ছাগলের রাঢ় ভূমিতে বিচরন দেখতে দেখতে ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো আকাশ ভেঙে। আরও কিছুটা চলার পর গাড়ি বাঁদিকের এক সরু রাস্তা ধরলো। বুঝলাম পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি।আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চারপাশে দৃশ্যগুলো বদলাতে শুরু করল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এসে আমরা পৌছালাম বন বাংলোয়।

প্রসঙ্গত, জানিয়ে রাখি গড়পঞ্চকোট পৌছানো যায় আদ্রা ,আসানসোল বা বরাকর স্টেশনে নেমে গাড়ি বা অটোতে। কেউ মাইথন ঘুরে গড়পঞ্চকোটে আসতে চাইলে কুমারডুবি স্টেশনে নেমে ৭ কিমি দুরে মাইথন এবং সেখান থেকে ২৩ কিমি গড়পঞ্চকোট। শুনেছি এই রাস্তার শোভাও নাকি মন ভোলানো।

পশ্চিমবঙ্গ বন দপ্তরের তত্ত্বাবধানে এই বন বাংলোয় থাকার জায়গা অনেক।এক সুবিস্তৃত অরন্যের মধ্যে পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে অত্যন্ত মনোরম এক প্রাকৃতিক পরিবেশে এই বনবাংলো। আমাদের আগে থেকে বুকিং করা ছিল না। ফাঁকা থাকায় ঘর পেতে অসুবিধা হল না। তবে অনলাইনে বুকিং করে আসাই শ্রেয় । বেশিরভাগই এক একটি দোতলা বাড়িতে উপর নিচ মিলিয়ে চারটে করে ঘর,সঙ্গে সামনের দিকে বিশাল বারান্দা।এই বারান্দায় বসেই সময় কেটে যায়।চারিদিকে অসংখ্য শাল,সেগুন, মেহগিনি গাছের জঙ্গলের মধ্যে খেলা করে বেড়াচ্ছে কাঠবেড়ালি, গান গাইছে নাম না জানা পাখির দল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় বসে সঞ্জয় বললো , ঠিক এমনটাই চেয়েছিলাম।এই নিস্তব্ধতা আমার খুব দরকার ছিল।আমি কোথাও আর নড়ছি না দুদিনের জন্য, শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা ।

এখানে খাওয়ার ঘর বা ক্যান্টিনটা খুব সুন্দর, সিঁড়ি দিয়ে একটু উঁচুতে উঠে, চারিদিকে বড় বড় কাঁচের জানালা। ক্যান্টিনের দায়িত্বে থাকা দাসবাবু, সব সময় মুখে হাসি লেগে আছে,অত্যন্ত অতিথিবৎসল। আমাদের দুপুরে তার ব্যবস্থা অনুযায়ী খুব কম সময়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আলাপ হল লক্ষনের সাথে।আদিবাসী ছেলে। প্রাণবন্ত, বন দপ্তরের গাছ কাটে এমনি সময়। আর বেশি টুরিস্ট এলে এখানে ডিউটি পড়ে। পাশের আদিবাসী গ্রামে থাকে। খাওয়া দাওয়ার পর বারান্দায় আড্ডা শুরু হল,পুরানো দিনের নানা মজার স্মৃতি রোমন্থন । ঠিক করলাম, বিকেল নাগাদ একটু হেঁটে আসবো চার পাশটা। যদিও সঞ্জয় যেতে রাজি নয় কিন্তু বিকেল হতেই শুরু হল অঝোরে বৃষ্টি । নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে একনাগাড়ে হয়ে চলেছে বৃষ্টি। শুধু বৃষ্টির আওয়াজের মধ্যে চারদিক জুড়ে ঝপ করে নেমে এলো অন্ধকার । বাংলোর রাস্তার ধারে ধারে জ্বলে উঠলো টিউবলাইট।

বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় গরম চা নিয়ে হাজির লক্ষন। সবাই যেন সবাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। লক্ষন আসতেই সবাই সম্বিত ফিরে পেলো। জয়দীপ লক্ষনকে জিজ্ঞাসা করলো,সন্ধ্যেবেলা কি পাওয়া যাবে ? লক্ষন মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। ও ঠিক বুঝতে পেরেছে- এই চার প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকের কি প্রয়োজন।যাই হোক ডিমের ভুজিয়া আর মাছ ভাজার অর্ডার নিয়ে বিদায় নিলো।

সন্ধ্যের আড্ডা জমে উঠলো বারান্দায়, সঞ্জয় গান ধরেছে – আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে ….বাইরে বৃষ্টির একটানা আওয়াজ, ঝিঁঝির ডাক আর পাতা থেকে খসে পড়া জলের টুপটাপ শব্দে কোথা দিয়ে যে তিন-চার ঘণ্টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। সময় মত লক্ষন এসে হাজির রাতের রুটি আর মাংসের ঝোল সুন্দর করে ক্যাসারোলে ঢেকে। বেশ রাত করে শুতে যাওয়া হলো। আসলে আমরা সবাই এই রাতের পুরোটা চেটে পুটে নিতে চাইছিলাম।

সকালে ঘুম ভাঙল অজানা নানা পাখির ডাকে।বারান্দায় এসে দেখলাম, আকাশের মুখ ভার,কেমন যেন থম মেরে আছে। সারা রাত বৃষ্টির পর চারিধার আরও সবুজ সতেজ লাগছে।বাংলোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেক শামুক। কৌশিক খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের ছবি তুলছে। চা এসে গেছে। জয়দীপ বললো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে,গাড়ি বলে দিয়েছি, আমরা যাবো পাঞ্চেতের ড্যাম দেখতে। ফেরার পথে দেখবো পঞ্চকোট রাজত্বের ইতিবৃত্ত।

কথামতো সকাল ১০টা নাগাদ রওনা দিলাম। জঙ্গলের রাস্তা ছেড়ে আবার আমরা বড় রাস্তায় পড়লাম। কিছুদূর যেতেই বাঁ হাতে ক্রমশ প্রকট হতে থাকলো পাঞ্চেত পাহাড়। আকাশ কালো করে আছে, দূর থেকে মনে হচ্ছে ওই পাহাড়ের মাথায় বাসা বেঁধেছে মেঘের দল। একটু এগিয়ে পুলিশি পাহারা টপকে ড্যামের ওপর উঠে পড়লাম। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম এক বিশাল জলাশয়, যার শেষ দেখা যাচ্ছে না। অনেক নিচে কিছু ডিঙি নৌকা পিকচার পোস্টকার্ডের মত ছড়িয়ে রয়েছে যত্রতত্র । আর এক পাশে সারি দিয়ে লকগেট, কিছু দূরেই বিদ্যুত তৈরির কারখানা, যদিও ঝাপসা মেঘলা দিনে। কৌশিক অনেক ছবি তুলছে,আমরাও সেলফিতে মশগুল। শুরু হল বৃষ্টি।তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলাম, জানলা দিয়ে ভিজে হাওয়া আসছে, ফিরে চললাম….সঞ্জয় গান ধরেছে – পাঞ্চেতের পাহাড়ে মেঘ জমেছে আহারে….

আমাদের গাড়ির ড্রাইভার সনাতন বাবু বেশ মজাদার মানুষ। বললো, আপনাদের মত বর্ষা দেখতে এখানে খুব কম লোক আসে। এখানে ভিড় হয় কাশফুলের থেকে পলাশফুল পর্যন্ত। গড়পঞ্চকোটে মেলাও বসে শীত কালে। তখন আদিবাসী নাচ,ধামসা,মাদলের বোলে হাড়িয়া, মহুয়ার গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক। আর ওই সময়ের কথা মাথায় রেখেই এখানে তৈরি হয়েছে আরও কিছু বেসরকারি রিসর্ট। কথা বলতে বলতে আমরা এসে পৌঁছালাম পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে আজ থেকে সাড়ে ছশো বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়া এই ইতিহাসের সামনে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ। তার মধ্যে পঞ্চরত্ন মন্দির, গড়পঞ্চকোটের গেট, জোড় বাংলো, রানী মহল যার ভগ্নাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়।

কথিত আছে, শেখর রাজবংশের রাজধানী ছিল এই পঞ্চকোট।প্রথম রাজা দামোদর শেখর ,পুরুলিয়া ও ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে রাজত্ব গড়ে তোলেন। এখানে তৈরি করেন বিশাল দুর্গ । গড় মানে দুর্গ, পাঁচ সর্দার তাই পঞ্চ আর কোট মানে গোষ্ঠী, এই থেকেই নাম হয় গড়পঞ্চকোট। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটা মন্দির ছিল যা পোড়ামাটি কিংবা পাথর দিয়ে তৈরি। শোনা যায়, আজ থেকে সাড়ে ছশো বছর আগে,আলিবর্দি খাঁর সময় বর্গী আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজত্ব । মা কল্যানেশ্বরীর মন্দির আসলে এখানেই ছিল। বর্গী আক্রমণের সময় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাইথনের কাছে। আমরা যদিও ইতিহাস জানতে আসিনি কিন্তু কেন জানিনা ইতিহাস আমাদের গ্রাস করলো আসতে আসতে। ইতিহাসে বুঁদ হয়ে চারপাশের সবুজ জঙ্গলের সাথে একাত্ম হতে হতে ফিরে চললাম বনবাংলোর দিকে।

পরের দিন সকালে আমাদের ফেরা,সনাতন বাবুই পৌঁছে দেবেন আসানসোল। বিল মিটিয়ে যখন গাড়িতে উঠবো,দেখলাম দূরে লক্ষন দাঁড়িয়ে আছে।কাছে ডাকলাম , ওর হাতে কিছু টাকা দেব ভেবে পকেটে হাত ঢুকিয়েছি সবে ,ও আমার হাতটা চেপে ধরলো, বললো আবার আসবেন। ওর লাজুক দৃষ্টি আর নির্মল হাসি সাথে করে বেড়িয়ে পড়লাম।

রাস্তায় আসতে আসতে মনে হল যার পূর্ব পুরুষরা বর্গীদের সাথে অসীম বিক্রমে যুদ্ধ করেছে, তাদের কিছু টাকা দিয়ে পরাজিত করি কি করে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version