সুউচ্চ পাহাড়ের উপর স্থাপিত বাতাসিয়া লুপের কিনারে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে মনে হচ্ছে, আশপাশের পুরো অঞ্চল সুবিশাল ও দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ে ঘেরা। উপরে মেঘের ঘনঘটার সঙ্গে আকাশের নীল আর নিচে পাহাড়ের ঢালু থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত নাম না-জানা বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের সবুজতা মিলেমিশে একাকার হয়ে অন্যরকম এক আবহ সৃষ্টি করেছে! দূর পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পাহাড়িদের ছোট ছোট ঘর আর সারি সারি নাম না জানা বৃক্ষের সমারোহ। কী অপূর্ব দৃশ্য! দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে! জায়গাটি যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমীর কাছে স্বর্গরাজ্য মনে হবে।

দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন শেষে ড্রাইভার বাতাসিয়া লুপ থেকে ঢালু ও খাঁড়া পাহাড়ি রাস্তার বাঁক ঘুরে রওনা হল রক গার্ডেনের দিকে ঝরনার স্রোতধারা দেখাবে বলে। উদ্যানটি দার্জিলিং থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু পাহাড়ি উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা থাকায় পাড়ি দিতে হয় ২৫-৩০ কিলোমিটার পথ। চলতি পথে মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারে দাগের আঁচড়ে চোখে পড়ছে ধাপে-ধাপে তৈরি কৃষি আবাদি খেত, কোথাও সমান্তরাল আবার কোথাও ধাপওয়ালা। ঢালু পাহাড়ে চাষ করা ভারি শক্ত আর বিপজ্জনক কাজ। পাহাড়ের চূড়ায় যেসব সাহসী একদল মানুষ যুগ যুগান্তের অসীম পরিশ্রম করে এই ধাপওয়ালা খেতগুলো তৈরি করেছে ফসল চাষের জন্য। মাঠের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে কোথাও  পাহাড়ের ছাদে চা বাগানের সবুজতা চোখে পড়ছে আবার কোথাও ফলের বাগান। তবে এখানে গবাদি পশুর তেমন দেখা মিলছে না।

কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ঠিক উপর থেকে নিচে গভীর বিস্তীর্ণ আর ঘন বনে ঢাকা উপত্যকার খাদের কিনার ঘেঁষে রক গার্ডেন দেখা যাচ্ছে। গাড়ি অনেকটা খাঁড়া পথে নিচের দিকে নামছে, দার্জিলিং শহরের মধ্যে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা। রাস্তাগুলোর ধরন দেখে এগুলো যে কয়েক শতাব্দি ধরে এলাকায় বসবাস করা মানুষের কর্মের ফল তা সহজেই অনুমান করা যায়। রাস্তাগুলো প্রশস্ত না-হওয়ার কারণে বিপরীতমুখী গাড়ি পাস হওয়ার সময় হঠাৎ অন্য গাড়িকে সাইড দেওয়ার জন্য মোড়ে মোড়ে ব্রেক করছে। এভাবেই গাড়ি কখনো বামে কখনো ডানে মোচড় খেয়ে চলার সময় যখন থেমে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে এই বুঝি গাড়ি ভারসাম্য হারিয়ে নিচে খাদের কিনারে চলে যাবে।

অবশেষে সেই কাঙ্খিত গন্তব্য দূর থেকেই দেখতে পেলাম, বিভিন্ন রঙের ফুলে শোভিত হয়ে আছে রক গার্ডেন। এখানে পর্যটকদের মন মাতানোর জন্য একসঙ্গে রয়েছে হ্রদ, ঝরনা ও পাহাড়। প্রতি দিন এখানে বিপুল সংখ্যক পর্যটক ভিড় করলেও আমাদের যাওয়ার পর কারো আনাগোনা ছিল না। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট একটি হ্রদ। পর্যটকদের কেন্দ্র করে আশেপাশে গড়ে উঠেছে ছোট কয়েকটি চা কফির দোকান। রাস্তা থেকে ঝরনার কাছে যেতেই চির চেনা কলরব মুখর ছলাৎ ছলাৎ স্রোতের ধ্বনি আমাদের কানের নিভৃত গহীনে এসে পৌঁছাল। অস্থির মনকে নিমিষেই স্বস্তি দিতে প্রকৃতির রয়েছে এক দুর্দান্ত শক্তি। বিশেষ করে প্রকৃতির অনেক সুন্দরের মাঝে ঝরনা হলো অন্যতম যা ভেতর থেকে অনুভূতিকে জাগ্রত করে। জলধারার কাছে আসার পর দীর্ঘ সময় বিরতিহীন যাত্রার কারণে ক্লান্ত হয়ে থাকা মনে যেন এক প্রশান্তির মলম মেখে দিলো স্রোতস্বিনী ঝরনা।  

মানুষ মন খারাপ হলেই ঝরনার কাছে ছুটে যায়। ঝরনা মানুষের সব মন খারাপ, অভিমান আর বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট দূর করে দেয়। বিশাল বিশাল কালো পাথর খণ্ড পড়ে আছে ঝরনার পথ চলার মধ্যে। ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে জলের কলকল মধুর সুরেলা গীত শুনলাম। তারপর পাহাড়ের সুউচ্চ শিখরের দিকে তাকিয়ে একান্ত মনে ভাবছি, ঝরনা কীভাবে পাহাড়ের বুকের পাথুরে ভাঁজ খুলে মায়াবি ছোঁয়া বুলিয়ে খুব যত্নে চূড়া হতে সমতলে পৌঁছে, পায়ের নিচে ধসে-পড়ে মিশে যাচ্ছে হ্রদের সঙ্গে। ঝরনার শীতল স্পর্শে রুক্ষ পাহাড় খুঁজে পেয়েছে প্রাণের ছোঁয়া। পাহাড়ের  বুকের রেখা ধরেই যুগ-যুগ বয়ে চলছে সে। পাহাড়ের বুকের মৃত্তিকা খুঁড়েই বসবাস গড়েছে ঝরনা। মনে হচ্ছে, প্রকৃতির মাঝে মানুষের মন ভালো করার এক অদ্ভুত ওষুধ রয়েছে, যা প্রকৃতির মাঝে একান্তভাবে মিশে গেলেই কেবলমাত্র অনুভব করা যায়। সৃষ্টিকর্তা যেন পাহাড় আর ঝরনা তৈরি করেছেন আপন রঙের মাধুরী মিশিয়ে।

হিমশীতল মেঘ ছুঁতে ছুঁতে সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে যতই উপরে যাচ্ছি মনের রোমাঞ্চ যেন ততই বাড়ছে। জীবনের খানিকটা সময় স্বপ্নের মতো সুন্দর জায়গায় কাটানোর শখ সবার মধ্যেই জাগে। আলাদিনের চেরাগের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর হাতের স্মার্টফোন নামক যন্ত্রটিতে ঘষা দিলেই মুহূর্তে ইউটিউব, গুগল ও অন্যান্য মাধ্যমে সব বিনোদন এসে হাজির হয় হাতের মুঠোয়। এসব দর্শনীয় স্থানগুলো ইউটিউবে ভিডিও দেখে আর পত্রিকার নিউজ পড়ে তথ্য সংগ্রহ করে চোখ বুজে কল্পনার জগতে প্রবেশ করে যতোটা সৌন্দর্য দাঁড় করানো যায়, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। অপরিচিত স্থানে গিয়ে মনের ক্লান্তি দূর করে মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করবে এই ভাবনায় মনে মাঝেমধ্যে ভ্রমণের জোয়ার আসে।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version