পছন্দের চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছে থাকে সব অভিনেতারই। মন প্রাণ দিয়ে সেই চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেও কসুর করেন না অভিনেতা। কিন্তু সেই চরিত্রের মেকআপটাও যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। চরিত্রকে দর্শকদের সামনে বাস্তবিক করে তুলতে মেকআপের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু সেই মেকআপেই ছিল তাঁর প্রবল অনীহা। বিশেষ করে যদি পরচুলা, দাঁড়ি-গোঁফ গাম দিয়ে লাগাতে হত। চামড়ার ওপর ঘন্টার পর ঘন্টা গোফ-দাড়ি-চুল লাগিয়ে রাখতে একেবারেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না তিনি।

তপন সিনহার ‘কাবুলিওয়ালা’ বার্লিন চলচিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার পর এক বিদেশি সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘হি ইজ সো গুড দ্যাট হি মেক্স ইউ ফরগেট অ্যাবাউট হিজ বিয়ার্ড’’। খুবই ঠিক কথা লিখেছিলেন ওই সাংবাদিক। হ্যাঁ, অভিনেতা তাঁর অপছন্দের নকল সাজপোষাক ভেদ করেই রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের কাবুলিওয়ালা চরিত্রটিকে রক্তমাংসের করে তুলতে পেরেছিলেন নিজের অভিনয় গুণেই।
তপন সিনহা যখন রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা সেলুলয়েড বন্দি করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তখনই নাম ভূমিকায় একজনের কথাই ভেবেছিলেন, তিনি ছবি বিশ্বাস। শুরু হল ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে কথা— ‘কাবলেদের সম্বন্ধে আমাকে একজন অথরিটি ভেবে নিতে পার, ওদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছি’, তপন সিনহাকে ছবি বিশ্বাস বলেছিলেন। তপন সিনহা বলেছিলেন, ‘তাহলে তো ওদের পুশতো ভাষাও একটু আধটু জানেন। কারন, কিছু সংলাপ পুশতুতে দিতে চাইছি কিনা’। ঘাবড়ে গিয়ে ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘সংলাপে আবার শুধু শুধু পুশতু মুশতু কেন? বুঝবে কে?’ তপন সিনহা বললেন, ‘না বুঝলেও চলবে, এতে অভিনয়ের একটা ডায়মেনশন আনতে পারে। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটা বাড়িতে অনেক কাবুলিয়ালা থাকতো, তাদের মধ্যে একজন পরপর কয়েকদিন এসে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতেন, তাতে বেশ কাজ হয়েছিল।

কিন্তু প্রথম দিন সেটে কাবুলিয়ালা বেশে ছবি বিশ্বাসের সাজ-পোশাক, মেকআপ দেখে চমকে উঠেছিলেন পরিচালক তপন সিনহা। তার ভাষায়, ‘কাবুলিয়ালা না সদ্য কবর থেকে উঠে আসা মহম্মদ বিন তুঘলক! তখন আমি মাসে তিনশ টাকা মাইনের জুনিয়র পরিচালক আর ছবি বিশ্বাস হলেন সে যুগের দুর্দান্ত অভিনেতা। সুতরাং ইগনোর্যান্স ইজ ব্লিস কথাটি ভেবে কাজ চালিয়ে যাই।’ কিন্তু কিছুদিন পর প্রযোজক অসিত চৌধুরী পরিচালক তপন সিনহাকে ভরসা দিয়ে জানান, যেটুকু কাজ হয়েছে ফেলে দিয়ে ফের শুরু করুন। ছবি বিশ্বাসকে জানানো হলে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে বলেন, কেন অভিনয়ে গোলমাল করেছি? তপন সিনহা বলেন, মেকআপ নিদারুন। গম্ভীর ছবি বিশ্বাস বলেন, একজন কাবুলিয়ালা তো একটু আধটু শৌখিন হতেই পারে। তপন সিনহা বুঝিয়ে বলেন, নিশ্চয় পারেন তবে রবীন্দ্রনাথের রহমত খাঁ নিতান্ত গরিব।

এবার রাজস্থান, পাঠানকোট, শ্রীনগর ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তপন সিনহা। একদিন ভোরবেলা তপন সিনহা ছবি বিশ্বাসকে বললেন শ’খানেক ভেড়া আর বেশ কিছু লোকজন নিয়ে শুটিং আপনি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে আসুন, সকালের আলোয় শ্যুট করবো। কিছুক্ষণ পর জিপে করে এসে নামলেন স্যুট পরা এক ভদ্রলোক, চমকে উঠলেন পরিচালক, একি তাহলে কাবুলিয়ালা? ছবি বিশ্বাস বললেন এই দারুণ লোকেশনে তো আমার ক্লোজ আপ নেবে না, তাই তোমার সহকারি বলাইকে কাবলে মেকআপ করিয়ে আনলাম, লঙে ট্রিট করলে কে ধরবে। দাঁড়ি গোফ গাম দিয়ে সাঁটতে কিছুতেই রাজি হতেন না, শুধু তাই নয়, একঘেয়ে লাগলেই তিনি ফাঁকি মারা শুরু করতেন। কিন্তু যতক্ষণ আনন্দ পেতেন অমানুষিক পরিশ্রম করতেন।

‘কাবুলিওয়ালা’ ছবি দেখে অনেকেই তপন সিনহাকে কাবুলিওয়ালার মেকআপ নিয়ে জানিয়েছিলেন। গাম দিয়ে ওই দাঁড়ি লাগানোর কারণে সর্বক্ষণ অসন্তুষ্ট থাকতেন অভিনেতা। দাড়িটা ভাল করে যে লাগানো নেই সেটা ছবিতে বেশ স্পষ্ট বোঝা যেত। কিন্তু সবটাই অভিনয়ে চাপা পরে যেত। কারণ অভিনেতার নাম ছবি বিশ্বাস।
আসল নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। ছোট বেলা থেকেই নাকি ছবির মতো দেখতে ছিলেন। তাই তাঁর মা আদর করে ডাকতেন ছবি। পরে সেই নামটিই লোকমুখে ছড়িয়ে যায়। একথাও জানা যায় যে রাজা শশাঙ্কদেবের বংশধর ছিলেন ছবি বিশ্বাস।

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে শিশির ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়কে পেশা হিসেবে বাছার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রী রঙ্গম মঞ্চে শিশির ভাদুড়ির নাটক যখন তেমন চলছিল না, সে সময় বিনা পারিশ্রমিকে শ্রী রঙ্গম মঞ্চে অভিনয় করতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি।
সবাই সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের কথা বলেন। বলারই কথা। পরিচালক নিজেও বলেছেন, ছবিবাবু না থাকলে এই দুটি ছবি কিভাবে হত ভাবা যায় না। তবে ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকও ছবি করার কথা ভেবেছিলেন। শংকরের ‘কত অজানারে’ ছবি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সে ছবি ঋত্বিক শেষ করতে পারেন নি।

‘কত অজানারে’ ছবিতে ব্যারিস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন ছবি বিশবাস। যে ধরনের চরিত্র বা অভিনয় তা ছবি বিশ্বাসের বাঁ হাতের খেল। কিন্তু শ্যুটিংয়ে ঋত্বিক ঘটক কিছুতেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। বারবার কাট কাট বলে উঠছেন, ‘হচ্ছে না ছবিদা, হচ্ছে না, ওকালতি হয়ে যাচ্ছে, ব্যারিস্টারি হচ্ছে না’। হতভম্ব ছবি বিশ্বাস ঋত্বিক ঘটককেই বললেন, ব্যারিস্টারি হচ্ছে না, ওকালতি হয়ে যাচ্ছে? তো আপনি ব্যারিস্টারের অভিনয়টা দেখিয়ে দিন।
ঋত্বিক ক্যামেরার পাশ থেকে উঠে এলেন। আর তারপর সেই সময়ের দাপুটে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে ব্যারিস্টারের অভিনয় করে দেখিয়ে দিলেন। শুটিং ফ্লোরে সবাই তটস্থ। ছবি বিশ্বাস কিন্তু পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলেন। এবং তাঁর নির্দেশ মতোই শট দিলেন। ছবি বিশ্বাস শটের শেষে বলেছিলেন, ‘এ ঢ্যাঙাও অনেক দূর যাবে’।