দেবী দুর্গার অনেক রূপ। কোথাও রঙে ভিন্ন, কোথাও সাজে, আবার কোথাও রূপে। দশভূজা, ত্রিভূজা প্রতিমার দেখাও মেলে। তবে মঠবাড়ির প্রতিমা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দ্বিভূজা। এক হাতে তাঁর সর্পরাজ ও অন্য হাতে ত্রিশূল। বাকি আট হাত ঢাকা থাকে চুলে। সিংহের রং সাদা ও মুখটি ঘোড়ার মুখের আকৃতি বিশিষ্ট। বৌদ্ধ বহু রীতিনীতি জড়িয়ে আছে এই পুজোর সঙ্গে। কোনও সন্ধি পুজোর প্রচলন নেই মঠ বাড়িতে। বাড়ির সদস্য সব্যসাচি চট্টোপাধ্যায়ের থেকে জানা যায়, একসময় অর্ধরাত্রে এ বাড়িতে নরবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু বংশের কোনও এক সন্তান সেই নরবলি তুলে দেন। সেই শরিক ও তাঁর বংশধরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যান পরবর্তীকালে। আপাতত নরবলির প্রতিকী হিসেবে চাল গুড়ো করে তা দিয়ে মানুষ আকৃতির মূর্তি তৈরি করা হয়। আলতা মাখিয়ে মানুষ স্বরূপ তাকে বলি দেওয়া হয়।
বলাগড় গুপ্তিপাড়ায় এক সময় টোলে পড়ার জন্য বাংলার বাইরে থেকেও ছাত্ররা আসত। গুপ্তিপাড়ার পণ্ডিতসমাজের শিক্ষাদানের বিস্তার ঘটতে থাকায় বলাগড় ও জিরাটের গ্রামগুলিতে পুঁথিপত্র লেখালেখি হয়। সেই প্রাচীন পুঁথিগুলি উদ্ধার করার পর জানা গিয়েছে বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি ধারা জিরাট তথা বলাগড় জুড়ে ছিল। সেই ধারা বেয়েই জিরাটের মঠবাড়িতে প্রায় ৪১৩ বছর ধরে দুর্গাপুজোর পরম্পরা বজায় রয়েছে।
প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা গিয়েছে, জিরাটের মঠবাড়িতে পাটুলি গ্রামে ছিল রাঢ়ীয় অবসতী চট্টোপাধ্যায় বংশীয়দের বাস। তাঁদেরই বংশধর মদনমোহন তর্কালঙ্কার জিরাটে এসে বসবাস শুরু করেন। মদনমোহনের বাড়ির কাছে প্রাচীন ইটের কারুকার্যময় বৌদ্ধমঠ ছিল। সেইজন্য মদনমোহনের বাড়িকে বলা হত মঠবাড়ি। মঠটি ধ্বংস হলে ১৩০৭ বঙ্গাব্দে মদনমোহনের বংশধরেরা দালান নির্মাণ করেন। এখানে দুর্গাপুজোর মন্দিরে দুটি শ্বেতপাথরের বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে। পুজোয় দু’হাত প্রকটে, আটটি হাত পিছনে আড়ালে রেখে গড়া হয় প্রতিমা। পিটুলির নরমূর্তি বলি দিয়ে যোগিনী পুজোর বিধি রয়েছে। মঠবাড়ির পিছন দিকে খানিকটা এগোলে ধর্মরাজ ঠাকুরের মন্দির। পূজারিরা ব্রাহ্মণ নন, বোধক সম্প্রদায়ের। মঠবাড়ির সদস্যদের থেকে জানা যায়, তাদের বাড়ির পুজো মহাযানী বৌদ্ধরীতিতে হয়, বাড়ির নিজস্ব ৪১৩ বছর আগের পুঁথি মেনে।
হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয়ের বহু উদাহরণ চোখে পড়ে। কিন্তু বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ের ঔজ্জ্বল্য দৃষ্টান্ত ‘আয়মা পাটুলির মঠ বাড়ি’র দুর্গাপূজা। প্রথম থেকেই বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে এই হিন্দু বাড়িতে পুজোর রমরমা প্রচলিত। ভক্তি, শান্তি ও গা-ছমছমে অনুভূতির সংমিশ্রণ পাটুলি মঠ বাড়ির দ্বিভূজা দুর্গাপুজো ও তার ইতিহাস। বাড়িটি হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের অন্তর্গত জিরাট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই বংশের সন্তান ছিলেন বলে জানা যায় ‘চট্টোপাধ্যায় বংশের একদেশ কারিকা’ থেকে। স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই মঠ বাড়ির দূর্গামাতা ‘মঠের মা’ নামে প্রসিদ্ধ।
দেবস্থানে নরবলি দানের প্রথা যে ভারতে বেশ ভাল ভাবেই প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বহু সাহিত্য ও কিংবদন্তীতে। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ থেকে শুরু করে ১৯ শতকের ‘কপালকুণ্ডলা’তেও নরবলি করে ইষ্টদেবীর সন্তুষ্টিবিধানের বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। এই প্রথা ছিল হুগলি জেলার জিরাট পাটুলির মঠবাড়ির পুজোতেও। প্রলয় কান্ড ঘটে গেলেও অর্ধরাত্রির পুজো হবেই। একইসঙ্গে দিতে হবে নরবলিও। এমনই কড়া ছিল রীতি। এর অন্যথা হলেই নাকি ঘটে যেতে পারে বড় কোনও অঘটন। এমনটাই বিশ্বাস করতেন সকলে। জানা গিয়েছে, এখন সপ্তমী ও অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে অর্ধরাত্রির পুজো হয়। তবে বাজারে প্রচলিত পুঁথি অনুযায়ী এই পুজো হয় না। পরিবর্তে পূর্বপুরুষদের তৈরি করা পুঁথি পড়ে পুজো সম্পন্ন হয়। এবং পুজো হয় বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে।
কথিত আছে, জিরাট পাটুলির মঠবাড়ি তথা চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোতে প্রত্যেক ১২ বছর অন্তর একটা নরবলি হত। আর এই নরবলি হত অর্ধরাত্রির পুজোর দিন। কিংবদন্তী শোনা যায়, ওইদিন নিজে থেকেই কোনও না কোনও মানুষ মঠবাড়িতে চলে আসতেন। পুজোর সব রীতি মেনেই দেওয়া হত নরবলি। এখন অবশ্য সেসব অতীত। তবে পরম্পরা আছে। এখন সেখানে প্রতীকী নরবলি দেওয়া হয়। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, চালের গুঁড়ো দিয়ে কুলোর উপর ‘নকল’ নর তৈরি করা হয়। সেই নরকেই লাল চেলি কাপড় পরিয়ে মন্ত্রপূত করে অর্ধরাত্রির পুজোর দিন বলি দেওয়া হয়। পুজোর দিন বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা থাকে মঠবাড়িতে। কথিত আছে, পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার আর্থিক ভাবে দুর্বল ছিলেন। তাই তিনি মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী দিয়ে ভোগ দেবেন মায়ের। দৈববাণীতে দেবী তাকে আদেশ দিয়েছিলেন, ডাল-ভাত ও কচুর শাক দিয়ে ভোগ দেওয়ার। তারপর থেকে তাই দেওয়া হয় ভোগে।