সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে যেমন চিন্তার শেষ নেই তেমনি দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। যে পুজোগুলির মধ্যে এমন ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের দেশের হিন্দু ও মুসলমান- দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতির ঐতিহ্য যে সুপ্রাচীন তা বুঝিয়ে দেয়। বাংলার আশেপাশে এমন উদাহরণ যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেকথাও বলে। এ ব্যাপারে একটি মস্ত উদাহরণ আরামবাগের সরকার বাড়ির প্রায় সাড়ে তিনিশো বছরের দুর্গাপুজো।
সন্ধে নামার আগেই যেন বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয় শঙ্খধ্বনিতে তেমনি বিভিন্নপ্রান্তে মিশে যায় আজানের সুর। এই উৎসবের মরশুমে আরামবাগের সরকার বাড়ির দুর্গাপুজোর ছবিটাও অনেকটাই তেমন। যে বাড়ির পুজোতে মন্ত্র নয়, বরং দেবীর আরাধনা শুরু হয় নামাজ পাঠের মধ্যে দিয়ে। আজকের ভীষণ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক হিংসার সময়ে দাঁড়িয়েও বাংলার চিরাচরিত ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির অনন্য ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ বাড়ির পুজোর আঙিনায়।
ঐতিহাসিক এই পুজোর সূচনা হয়েছিল ৩৫০ বছর আগে। জমিদার বাবুরাম সরকারের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আরামবাগের প্রাচীনতম এই পুজো। তবে হিন্দু জমিদার বাবুরাম সরকারের অধিকাংশ প্রজাই ছিলেন মুসলমান ধর্মালম্বী। তাই তাঁর পুজো এবং পুজো ঘিরে উৎসব কেবলমাত্র হিন্দুদের উৎসব হয়ে উঠুক, তা কিন্তু হিন্দু হয়েও তিনি চাননি। বরং চেয়েছিলেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই দুই সম্প্রদায়ের হলেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুজোয় সমান ভাবে অংশ নিক। তাই তিনি পুজোর প্রাক্কালে নামাজ পড়ার প্রথা চালু করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দুর্গাপুজো জাতি, বর্ণ, ধর্ম, নির্বিশেষে তাঁর সন্তানসম সকল প্রজাদের হয়ে উঠুক। সেই ভাবনা থেকেই তিনি ঠাকুর দালানে পুজোর সময় নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। একদিকে হতো সন্ধ্যারতি, অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নামাজ পড়তেন।
তিন শতক পেরিয়ে এসেও সরকার বাড়ির পুজোর সময় নামাজ পড়ার প্রথার ছেদ পড়েনি। এলাকার হিন্দু মুসলমান সকলেই এই পুজোর আনন্দে শামিল হন। বাড়ির এক প্রবীণ সদস্য বলেন, প্রতিপদে ঘট ভরতে হয়। সেদিন থেকে পুজো শুরু হয়ে যায়। প্রথা ও রীতি মেনে পুজোর সব আচার পালন করা হয়। নামাজ পড়াও সেই আচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিন ছাগবলি হয়। দশমীর দিন চ্যাং মাছ বলি হয়। বাড়ির মেয়েরা সন্ধিপুজোর সময় ১০৮টি প্রদীপ জ্বালান।গত তিরিশ বছর ধরে আব্দুল মতলেব নামের এক ব্যক্তিই পড়ে আসছেন নামাজ। সঙ্গে বহু ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষও অংশ নেয় এই অনুষ্ঠানে। বনেদিয়ানার জমিদারবাড়ির আনাচে-কানাচে জুড়ে থাকে সম্প্রীতির সুর।
আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর আগের সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলার এক জমিদারের এমন সিদ্ধান্ত জেনে সত্যি অবাক হতে হয়। ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা যে তখন আরও প্রকট ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়েও এক হিন্দু জমিদার দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতু বন্ধনের এই উদ্যোগ যেমন তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় রাখে তেমনই তাঁর উদার মানসিকতার কথা জানায়। আরামবাগের এই মাটিতে ছিল একাধিক পীর ফকিরদের আস্তানা। তাঁরা দুই সাধনার ধারাকে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভালিয়ার সরকার বাড়ির পুজো সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে। জমিদারি জৌলুস অনেকদিন আগেই হারিয়েছে। তবু ঐতিহ্য, বাঙালিয়ানা আর সম্প্রীতির এই পুজো ঘিরে আকর্ষণের শেষ নেই। বাংলার মাটিতে একসময় পীর ফকিরের সাধনা ও লোকায়ত ধর্মের মেলবন্ধন ঘটেছিল। তারই নজির আরামবাগের প্রত্যন্ত এলাকার সরকার বাড়ির এই পুজো।