পঞ্চম পর্ব
রূপসা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক নদী। ভৈরব নদ থেকে সৃষ্ট নদীটি আসলে পদ্মার একটি শাখা। কথিত আছে যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নড়াইল জেলার ধোন্দাগ্রামের রূপচাঁদ সাহা নামক এক বিত্তবান লবণ ব্যবসায়ী নৌকায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভৈরব নদের সঙ্গে কাজীবাছা নদীর সংযোগ করতে একটি খাল খনন করেছিলেন। রূপচাঁদ সাহার নাম অনুসারে ঐ খালের নাম হয়েছিল রূপসা। পরবর্তীকালে ভৈরব নদের এক ভয়ংকর প্লাবনে এই ছোট খাল বিশাল এক নদীতে পরিণত হয়। রূপসা শুধু নিজেই নদীতে পরিণত হয়ে থামেনি, কাজীবাছা নদীকেও বিরাট ভাঙনের মুখে ফেলে দেয়। ‘রুপসা-পশুর’ সুন্দরবনে’র মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া এক নদী। এ নদী দক্ষিণে মংলা বন্দরের কাছে পশুর নাম নিয়ে ত্রিকোন ও দুবলা দ্বীপ দুটির ডান পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
রূপসী রূপসার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল জীবনানন্দের কাব্যে আজ তার বুকের উপর দিয়ে পার হবো ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগছিল। লাইনগুলো সঠিক ভাবে স্মরণে আসছিল না, বাড়িতে ফিরেই তাই বই ঘঁটতে হলো। “হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;/ হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;/হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে/ রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে/ডিঙা বায়; রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে/ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।” চোখ ভিজে ওঠে। রূপসী রূপসাকে অবশ্য প্রাণ ভরে দেখতে পেলাম না, তখন বেশ অন্ধকার। কালো জলে শুধু আলোর প্রতিফলন। দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দও কানে এল না সবই ঢাকা পড়ে গেছে মোটর চালানো বোটের ভট ভট শব্দে। শুধু স্টিমারের দু’চারটে ভোঁ ভাঁ। ফেরার সময় রূপসা তার রূপের এক ঝলক দেখিয়ে ছিল শুধু। তাড়া ছিল অন্য জায়গা যাওয়ার তাই রূপসার পাড়ে দাঁড়ানোর ফুরসৎ মেলেনি। তখনই ভেবে রেখেছি এই রূপসার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় করতে হবে। আগামী বার রূপসার বুকে অন্তত ১০ ঘন্টা ভেসে চলে যাবো সুন্দরবনের দিকে।
রনি শুধু আমাদের রূপসার ফেরি ঘাটে ছেড়ে দেয়নি, এপারে বাইক রেখে নদী পার করে পৌঁছে দিল ওপারে। অনেক গলিঘুঁজি পেরিয়ে ধরিয়ে দিল আটো, এরা বলেন সিএনজি। এই সিএনজিই নাকি আমাদের সরাসরি পৌঁছে দেবে ফকিরহাটে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো আরও প্যাসেঞ্জারের জন্য। রাস্তার দূরত্ব নাকি বেশ খানিকটা। শীতের রাত তাই প্যাসেঞ্জার কম। নদী পেরিয়ে অটো না ধরে দুটো বাস পালটে আমরা চলে আসতে পারতাম ফকিরহাটে। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রাত হোক ক্ষতি নেই, বাস পালটা-পাল্টির ঝামেলায় আর যাবো না। রূপসার বেশ খানিকটা তফাতে এই অটোর স্ট্যান্ড, টিমটিমে আলো জ্বালা সারি সারি খাওয়ার দোকান। বেশ বড় বড় সাইজের মুচমুচে কচুরি সাজানো রয়েছে, মিষ্টির চেহারাও আমাদের ওখানকার মতোই। স্বাদের পার্থক্য কতটা সেটা অবশ্য পরখ করা হয়নি। একসময় অটো ছাড়লো, ‘কাল বাদে পরশু আবার দেখা হবে’ বলে বিদায় নিল রনি। কিছুটা ভাঙাচোরা নির্জন রাস্তা ঠেঙিয়ে আমাদের অটো ছুটে চলল অন্ধকার চিরে। রাস্তার দু’পাশেই প্রচুর গাছ, মাঝেমধ্যে দু’চারটে ছোটখাটো গঞ্জ। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ, ভেবেছিলাম বেশ ঠান্ড হবে কিন্তু খুব একটা ঠান্ডা নেই। রাস্তায় কিন্তু লোকজন বেশ কম। একসময় আটো আমাদের পোঁছে দিল ফকিরহাটে।
ফকিরহাট বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মধ্যে একটি বিখ্যাত জনপদ। জনশ্রুতি আছে যে, ফকির মঙ্গল শাহ্ নামে এক আধ্যাত্মিক মুসলিম সাধক ভৈরব নদীর দক্ষিণ তীরে বর্তমান পুলিশ স্টেশনের কাছে তার আস্তানা গেড়ে ছিলেন। এই সাধক নাকি ছিলেন অলৌকিক এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। কালে কালে ঐ ফকিরের আস্তানাকে কেন্দ্র করে দোকান পাট বসতে শুরু করে। দিনে দিনে তা বৃদ্ধি ও প্রসার লাভ করে হাটে পরিণত হয়। ফকিরের আস্তানাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই হাটই পরিচিতি পায় ফকিরহাট নামে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকেই কৃষি প্রধান ফকিরহাট ছিল রাজনীতি সচেতন একটি এলাকা। পাকিস্তান আমলে ৬ দফার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, সবেতেই ফকিরহাটের মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনের পরে ফকিরহাটের ছাত্র ও যুবকেরা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ফকিরহাট থানার প্রায় সর্বত্র তখন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চলছিল গণবিক্ষোভ।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ফকিরহাটে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে শেখ আলী আহম্মদ এবং শিবপ্রসাদ ঘোষ। ফকিরহাটের বহু মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিহার’ (সাতচড়া ইউথ রিসেপশন ক্যাম্প), চাকুলিয়া, দেরাদুন, তাকিপুর, বাকুন্দীয়া হাইস্কুল, বাকুন্দীয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের কম্যান্ডার মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগ দেন। পাক বাহিনী ফকিরহাটের মানসা বাজারে আক্রমণ চালাতে আসছে, এমন খবর পেয়ে বামপন্থী নেতা মোড়ল সিরাজুল ইসলাম ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু দুর্ভাগ্য মুক্তি যোদ্ধারা পৌঁছানোর আগেই হানাদার ও রাজাকার বাহিনী সেখানে চলে আসে। তারা বাজারের সব দোকান জ্বালিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রচুর মানুষকে হত্যা করে। মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ে সিরাজুল ইসলাম যখন পোঁছান তখন মানসা বাজার প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়েছে। তাঁরা লাশ শনাক্ত করে যথাযথ মর্যাদায় তুলে দেন পরিবারের হাতে। রাজাকারদের সহযোগিতায় ভৈরব নদী পেরিয়ে মানসা বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে পাক হানাদারেরা অনুপ্রবেশ করে। ফকিরহাটে পাক বাহিনীর কোন ক্যাম্প না থাকলেও লখপুর ইউনিয়নে ছিল রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি। এই রাজাকারেরা ছিল পাক হানাদার বাহিনীর পথ প্রদর্শক আর যাবতীয় নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের দোসর।
আজকের সবুজ ঘেরা অভিনব কৃষি ক্ষেত্র শান্ত ফকিরহাটকে দেখে কিছুতেই অনুমান করা যায় না এখানে এত রক্ত ঝরেছে একদিন। ফকিরহাটের মোড় থেকে আমাদের যেতে হবে আরও খানিকটা ভেতরে। আমরা যাবো হোচলা, সেখানেই নিখিলকৃষ্ণ মজুমদার তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তাঁর আনন্দনিকেতন তাঁর আশ্রম তাঁর প্রাণের ‘মুরলী সংস্কৃতিক বিকাশ ও গবেষণা কেন্দ্র’। একটা ভ্যান রিক্সায় সওয়ার হলাম। রিক্সাওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিল তৈয়ব আলী বটতলায়। এখান থেকে এবার হাঁটা পথ। অন্ধকার রাত, চারিদিক শুনশান বেশ নিঝুম। রাত কিন্তু খুব গভীর এমনটা নয়। এবড়ো খেবড়ো ইট বিছানো অপরিচিত রাস্তায় ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে গেলাম বেশ কিছুটা। ম্লান আলোয় চোখে পড়ে অজস্র গাছপালা ঘেরা কয়েকটা ঘর। আরও কিছুটা হোঁচট খেয়ে কানে ভেসে এল দোতারা, বাঁশী আর খোল কর্তালের মিঠে সুর। বুঝলাম আমরা পৌঁছে গেছি নিখিল বাবুর আন্তরিক ঠিকানায়। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা।
সুত্র:- বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ষষ্ঠ খন্ড।
চলবে…