বঙ্কিমজীবনীকার শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (বঙ্কিমের ভাইয়ের ছেলে) ‘বঙ্কিম-জীবনী’ থেকে জানা যায় কাঁঠালপঠারই একজন বঙ্গবিশ্রুত গায়ক যদুভট্টকে পঞ্চাশ টাকা বেতন দিয়ে তিরিশোর্ধ বঙ্কিম গান শেখা শুরু করেছিলেন। যদিও বঙ্কিমের সংগীত চর্চা খুব নিয়মিত হয় নি। কারন ১৮৬৯-এর ১৫ ডিসেম্বর তিনি বহরমপুরে কাজে যোগ দেন, ১৮৭২-এ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশের পর থেকেই বঙ্কিম সপ্তাহান্তে কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে ফিরতেন, তাঁর বাড়িতেই বসত ‘বঙ্গদর্শন’-এর মজলিশ, সেখানে যদুভট্টও উপস্থিত থাকতেন। শোনা যায় শৈশব থেকেই বঙ্কিম মুখে মুখে গান রচনা এবং তাতে সুর সংযোগ করতেন। যখন বঙ্কিমের ১৩-১৪ বছর বয়স সেই সময় দাদা ও ভাইদের সঙ্গে নৌকায় ভাসান দেখতে বঙ্কিম ফরাসডাঙ্গা যাচ্ছিলেন। ভাগীরথীর পূবপাড়ের শ্মশানে তখন শবদাহ হচ্ছিল। শ্মশানে এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে জলন্ত চিতায় ঝাপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, এই ঘটনায় বঙ্কিমের চোখ জলে ভরে যায়। কিশোর বঙ্কিম নৌকায় বসেই একটি গান লিখে সুর সংযোগ করেছিলেন। বহুকাল মল্লার রাগিনীতে তৈরি ‘হারালে পর পায় কি ফিরে মণি – কি ফণিনী, কি রমনী?’ প্রচলিত থাকার পর লুপ্ত হয়ে যায়।
ভারতীয় মার্গসংগীত থেকে কীর্তন; বাংলা লঘু বা চটুল গান বঙ্কিমের উপন্যাসে রয়েছে, সব গান তাঁর রচনা নয়। অনেক গানে আবার অন্য গানের সরাসরি প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, কোনো গানের সংগ্রাহক বঙ্কিম নিজে। নিজের লেখা গানে বঙ্কিম কেবল রচয়িতা নন, রাগ-তাল-এর যথাযথ উল্লেখ দেখে বোঝা যায় সংগীত সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা কতখানি গভীর। ‘মৃণালিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’র মতো সখ্যায় বেশি না হলেও গান রয়েছে ‘ইন্দিরা’তেও। ‘একা কাঁখে কুম্ভ করি, কলসীতে জল ভরি,/ জলের ভিতরে শ্যামরায়’। এই প্রাচীন গীত ইন্দিরার মনে পড়ে নৌকা চড়ে গঙ্গা দিয়ে কলকাতা যাওয়ার সময়। পাঠকমাত্রেই সাহিত্য সম্রাটের সঙ্গীত প্রসঙ্গে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম খন্ডের দশম পরিচ্ছেদে ‘বন্দেমাতরম’ গানটির কথা বলেন। যে গান ভারতের জাতীয়তার মহামন্ত্র। গানটি বঙ্কিম ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস লেখার অন্তত ছ-সাত বছর আগে লিখেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ফুটনোটে আছে মল্লার রাগ ও কাওয়ালি তালে গানটি গীত। শোনা যায় বঙ্কিমের সংগীতগুরু যদুভট্ট গানটিতে প্রথম সুরারোপ করেছিলেন কিন্তু কোন রাগ বা তালে তা জানা যায় না। বন্দেমাতরম ছাড়াও ‘আনন্দমঠ’-এ আরও গান আছে, দ্বিতীয় খন্ড দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বাগীশ্বরী রাগিনীতে আড়া তালে শান্তিকে গাইতে দেখি, ‘দড় বড়ি ঘোড়া চড়ি কোথা তুমি যাও রে… পায়ে ধরি প্রাণনাথ আমা ছেড়ে যেও না’। তৃতীয় খন্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে শান্তি ও তাঁর স্বামী যুগলকন্ঠে গায়, ‘এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?/ হরে মুরারে; হরে মুরারে’। এছাড়াও ব্রহ্মচারী সত্যানন্দ ও শান্তির গলায় বঙ্কিম রেখেছেন জয়দেব গোস্বামী বিরচিত পদ—‘ধীর সমীরে তটিনীতীরে বসতি বনে বরনারী…’ তৃতীয় খন্ডের সপ্তম পরিচ্ছেদে শান্তি গায় গোস্বামী কবির দশাবতার স্ত্রোত্র, ‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম…’
উপন্যাস ছাড়াও বঙ্কিমের গান পাওয়া যায় ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ। কমলাকান্ত প্রসন্নকে শুনিয়েছিলেন, ‘এসো এসো বঁধু এস, আধ আচারে বসো…’। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে ধনকুবের জগতশেঠ ভাইদের জলসাঘরের ঐশর্যমন্ডিত সংগীতসভায় মনিয়াবাঈকে ‘সনদি খিয়াল’ গাইতে দেখা যায়, ‘শিখো হো ছল ভালা’। অনুমান মেটিয়াব্রুজে ওয়াজেদ আলি শাহ-র সভাগায়ক সনদপিয়া রচিত ঠুমরি হল সনদি খিয়াল। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের চতুর্থ খন্ড প্রথম পরিচ্ছদে মোগল সেনার বেশে মানিকলালের গলায় বঙ্কিম রাখেন উত্তর-মধ্য ভারতের লোকভষার একটি গান, ‘শরম ভরমসে পিয়ারী,/ সোমরত বংশীধারী,/ঝুরত লোচনসে বারি…’ এরকম উদাহরণ আরো রয়েছে বঙ্কিমের উপন্যাসে এবং লেখায়। প্রশ্ন, বঙ্কিমের এই সংগীতপ্রীতি এবং সংগীত বিষয়ে গভীর ধারণা কোথা থেকে কিভাবে হয়েছিল?
বঙ্কিম বাংলায় রাগ সংগীত চর্চার সুবর্ণ যুগের মানুষ। একদিকে মেটিয়াব্রুজে লখনউয়ের সিংহাসনচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর সংগীত দরবার, যার স্পষ্ট প্রভাব বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে বর্ণিত নবাব কতুল খাঁর নাচগানবিলাসিতার মধ্যে অনেকখানি ধরা পরে, অন্যদিকে পাথুরিয়াঘাটার রাজা যতীন্দ্রমোহন ও শৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুরের গানবাজনার আসর, এছাড়াও কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িসহ কয়েকটি বনেদি বাড়ির সংগীত চর্চা ও বৈঠকি আড্ডা কলকাতার সেই সময়কার সংগীত চর্চাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। প্রসঙ্গত, বঙ্কিম ছিলেন শৌরিন্দ্রমোহনের খুবই ঘনিষ্ঠ, তাঁদের বাগানবাড়ি মরকতকুঞ্জে ১৮৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সরস্বতী পুজোর দিন অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক কলেজ রি-ইউনিয়নে বঙ্কিম শৌরিন্দ্রমোহনের গান শুনতে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্কিমের কাঁঠালপাড়ার বাড়িতেও গৃহদেবতা রাধাবল্লভের নানা পার্বণ উপলক্ষেও যাত্রা, পালাগান, কথকতা ইত্যাদি লেগেই থাকত। শৈশবাবস্থা থেকেই বঙ্কিম ওই সাঙ্গিতীক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠায় তার কান গানের জন্য যে তৈরি হয়ে উঠেছিল তা বলাই যায়। পরবর্তীকালে একটু বেশি বয়সে তিনি রীতিমতো নাড়া বেঁধে তাঁর থেকে দু’বছরের ছোট সেই সময়ের প্রখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী যদুভট্টের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন।
সঙ্গীতপ্রেমী বঙ্কিম বাংলার নিজস্ব ধ্রুপদী সংগীত কীর্তনের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। সেই আগ্রহ থেকে তিনি সংগ্রহ করতেন বৈষ্ণব গীতিপদ, তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে ছিল বহু কীর্তন গান।বঙ্কিমের সঙ্গীতপ্রীতি কেবল কীর্তন গান নয়, তিনি বাউল গানেরও একজন মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে তাঁর নিজস্ব ভাষা শৈলীতে যেমন কীর্তনাঙ্গের গান বেধেছেন পাশাপাশি ‘সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে’র মতো যে গান রচনা করেছেন তাতে লালন বিরচিত ‘চাতক স্বভাব না হলে…’ কিংবা লালন শিষ্য গোঁসাই গোপালের ‘না জেনে অকুল পাথারে ভাসালাম তরী’ ইত্যাদির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৭ শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে লালনের সহজিয়া গান ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কর্মজীবনের শুরুতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমকে ঘুরতে হয়েছিল যশোর, খুলনার গ্রামে গঞ্জে। গানের টানে বঙ্কিমও কি সেই মাটিতে পা রেখেছিলেন, মাতোয়ারা হয়েছিলেন একতারার সহজ সুরধ্বনিতে? তাঁর সঙ্গে কি লালন ফকিরের দেখা হয়েছিল? এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্যপ্রমান মেলেনি তবে বঙ্কিম কীর্তনের মতো বাউল গানেরও ভক্ত ছিলেন, হয়তো বঙ্কিম কীর্তনের মতো বাউল গানেরও সংগ্রাহক ছিলেন।