শেষ পর্ব                         

কথায় কথায় জুলিকে বললাম বাংলাদেশে যাবার ইচ্ছে দেশের বাড়ি দেখতে। জুলি বলে ওর ইচ্ছে কিন্তু সঙ্গী নেই। জিজ্ঞেস করি কোন জেলা?

–খুলনা, বাগেরহাট

–আমারও তাই, গ্ৰামের নাম?

–সোতাল

আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। একই জায়গার মেয়ে আমরা (পরে জেনেছি একই পাড়ার পাশাপাশি বাড়ি) অথচ জানতামই না। ওকে মিলনদার কথা বলি,যোগাযোগ হয়। পরিকল্পনা চলতে থাকে দুজনের। মিলনদা ভারতে আসেন সেমিনারে যোগ দিতে, আমাদের আড্ডা জমে কলকাতায়। বাংলাদেশে মিলনদার পরিবারের সবাই আমাদের চিনে গেছে ইতিমধ্যে। লকডাউনের আগে সেজকাকা বাংলাদেশে গেলেন,গ্ৰামের বাড়ি দেখে এসে কত গল্প। অবশেষে এবছর অক্টোবরে ভিসা করতে দেওয়া হয়। নভেম্বরে ভিসা পেয়ে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করি। আমি,জুলি, অদিতি, অনিতা। অদিতি জুলির পিসতুতো বোন। যাবে মামার বাড়ি দেখতে। অনিতা ওর জ্যাঠতুতো বোন যাবে শুধু বেড়াতে। এক সকালে ব্যাগপত্তর নিয়ে চড়ে বসলাম বনগাঁ লোকালে। সীমান্ত পেরোতে পাঁচঘন্টা লাগলো। বেনাপোল পৌঁছে হোটেলে ভাত খেয়ে,বাস অফিসে বিশ্রাম করে বিকেল পাঁচটায় বাগেরহাটের বাসে উঠলাম। বাংলাদেশের বিখ্যাত আতিথেয়তার শুরু প্রায় সেখান থেকে। মিলনদা অফিসে ফোন করে দিলেন,আ্যডভোকেট মিলন ব্যানার্জী বেশ পরিচিত নাম ওখানে। সারা রাস্তা সবাই খোঁজ খবর নিয়ে যত্ন করে বাগেরহাট পৌঁছে দিল। রাত তখন সাড়ে নটা,স্ট্যান্ডে মিলনদা উপস্থিত। বাড়ি নিয়ে গেলেন, সকলের হাসিমুখে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে মন ভরে গেল।

রাতটুকু বিশ্রাম করে পরদিন সকালেই সোতাল গেলাম। ভৈরব নদীর পাড় ধরে যাবার পথে যেসব দৃশ্য দেখলাম মনে হল না পশ্চিমবঙ্গের থেকে কোনোভাবে আলাদা। একইরকম গ্ৰাম,ভাষা, পোশাক, গাছপালা। নারকেল,সুপুরি গাছের আধিক্য বেশি। পথে দেখলাম যাত্রাপুরের রথ। এই রথের মেলার গল্প অনেক শুনেছি বাড়িতে। গ্ৰামে পৌঁছে চলে এলাম পূবপাড়ায়, আমাদের বাড়ি। ভগ্নপ্রায় দশা, বর্তমান বাসিন্দা কুদ্দুস মিঞার পরিবার আমাদের খুব যত্ন করলেন। গাছের ডাব কেটে দিলেন সমস্ত বাড়ি ঘুরে দেখালেন। এরপর শুরু হল জুলির বাড়ির খোঁজ। সারা গ্ৰাম ঘুরে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা গেল আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে জুলির বাড়ি। জুলির মনে খুব আনন্দ। পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হল। দুপুরে খাওয়ার জন্য খুব আপ্যায়ন করলেন বর্তমান বাসিন্দা মাহমুদ মিঞার মা। খাওয়া সম্ভব হয়নি তাই দুটো চালকুমড়ো গাছ থেকে কেটে দিলেন। গাছের ছোট্ট ছোট্ট আমলকি দিলেন একগাদা। 

সকলেই আবার আসার নেমন্তন্ন করলেন। মনের অদ্ভুত অবস্থা তখন। বিষণ্ণতা আর ভালোলাগা দুরকম অনুভূতি নিয়েই ফেরার পথ ধরলাম।

আনন্দের মাঝে একটু দুঃখ… বাংলাদেশ ‌‌সীমান্ত যখন পেরোচ্ছি তখন রক্ষীদের ব্যবহার বেশ অবাক করল। যে দেশের আতিথেয়তা এত সুন্দর তার সীমান্তরক্ষীদের আচরণ মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। ঢোকার সময় ব্যাগ চেকিং নিয়ে একপ্রস্থ বাদানুবাদ। বেরোবার সময় যে কাগজ আমাদের প্রয়োজন নেই সেই কাগজ/ফর্ম নেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি, অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। কোনও অজ্ঞাত কারণে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প দেওয়ার জন্য কাউন্টার থেকে চারশ টাকা নেওয়া হল,কোন রসিদ দেওয়া হল না। তারপর গেট পেরোবার সময় অমানুষিক ভিড়, বিশৃঙ্খল অবস্থা। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জল নেই, টয়লেট ব্যবস্থা নেই,রোদে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে যখন ভারতে ঢুকলাম তখন নাভিশ্বাস উঠছে। সকাল সাড়ে সাতটায় বাসে উঠে বেনাপোল পৌঁছে গেছি প্রায় দশটা। গেট পেরোতে বাজল পৌনে চারটে। এই ব্যবস্থার যদি একটু উন্নতি হয় সাধারণ ভ্রমণার্থীরা উপকৃত হবেন আশা করি।

(শেষ)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version