তাঁরএক মেয়ে লন্ডনে পড়তে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। খবর পেয়ে তাঁর বন্ধুস্থানীয় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ প্রমুখ দেখা করতে গিয়ে দেখেন তিনি চিরকালের অভ্যাস অনুযায়ী জানালার পাশে বসে বই পড়ছেন। ওঁদের দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে বললেন, “ও, আপনারা খবর পেয়েছেন? হ্যাঁ, কাল মাঝরাতে টেলিগ্রাম এল।” একটু চুপ করেথেকে বললেন, “আচ্ছা, আপনারা তা হলে এখন আসুন। আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে ওগুলো করতেহবে।” ওঁরা দেখলেন, শোকতপ্ত মানুষটি অসীম দৃঢ়তায় আবার নিজের কাজে গিয়ে বসলেন।

এমন বিয়োগান্তক ঘটনা তার জীবনে বারবারই ঘটেছে। এমন দুঃসংবাদও তাঁকে জীবনভর ঘিরে রেখেছিল। একটার পর একটা মর্মান্তিক শোক তিনি সহ্য করছেন মুখ বুজে। নৌবাহিনীতে কর্মরত এক জামাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাহাজডুবি হয়ে মারা যান। ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গায় তাঁর বড় ছেলে আততায়ীর হাতে নিহত হন। একটার পর একটা দুঃখ-তাপ কিন্তু তাঁকে দমাতে পারে নি। তাঁর দুই নাতি ফৌজি প্রশিক্ষণ নিয়ে পরীক্ষা পাস করে ফুর্তি করত বেড়িয়ে জিপ উল্টে মারা যায়। পরদিন সকালে কিছু কাজ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তপন রায় চৌধুরী। তখন ওঁর কাজে সাহায্য করতেন ইতিহাস জ্ঞানসম্পন্ন সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজের ইতিহাস বিভাগের তরুণ শিক্ষক তপন রায় চৌধুরী; যিনি পরবর্তীতে অক্সফোর্ড-এর খ্যাতনামা সামাজিক ইতিহাসকাররূপে প্রতিষ্ঠিত হন।তিনি ‘বাঙালনামা’সহ একাধিক মনোমুগ্ধকর গ্রন্থও প্রণয়ন করেন। সেদিন প্রথম তিনি নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলেন, “শুনেছ তো? আর যে ক’টা আছে তারাও কেউ থাকবে না। এটাই আমার ভাগ্যলিপি।”

ইতিহাসে তাঁর প্রথম অবদান মির্জা নাথান রচিত ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবি’ পান্ডুলিপির পরিচিতি ঘটানো। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে খুঁজে পাওয়া এই পাণ্ডুলিপি তিনি বিভিন্ন জার্নালে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় টিকা ও বিশ্লেষণসহ প্রকাশ করেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি আওরঙ্গজেবের ইতিহাস রচনা শুরু করে ষাট বছর বয়সে ছয় খণ্ডে শেষ করেন। সেটা শুধু আওরঙ্গজেবের ইতিহাস নয়, মুঘলদের জয় ও শাসনের অনুগামী হয়ে সারা ভারত পরিক্রমা, সমস্ত রাষ্ট্রশক্তির উত্থান-পতনের ইতিহাস। এরপর ষাট বছর বয়সে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস লিখতে শুরু করে শেষ করেন আশি বছর বয়সে।

তার আগে মুঘল ইতিহাস রচনায় শুধু দরবারি ইতিহাসেরই সাহায্য নেওয়া হত। কিন্তু তিনি কোর্ট বুলেটিন, চিঠিপত্র, বিদেশি কোম্পানির কাগজ, প্রাদেশিক ও বেসরকারি ইতিহাস, ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার ইত্যাদির ব্যবহার শুরু করেন। ‘History of Aurangzib’-এর পাঁচ খণ্ডে আওরঙ্গজেবের জন্ম, শিক্ষালাভ, প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব, উত্তরাধিকারের যুদ্ধ, রাজপুত যুদ্ধ, ধর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, পূর্ব ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার, বিজাপুর-গোলকুন্ডা দখল, শিবাজির সঙ্গে সংঘাত থেকে আহম্মদনগরে তাঁর মৃত্যুর তথ্যভিত্তিক আলোচনা।  করেছেন। তবে তাঁর একটি প্রবণতা ছিল ঘটনা এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাস রচনার দিকে। এই প্রবণতা আমরা দেখতে পাই তাঁর ১৯১৩ সালে রচিত ‘Chaitanya’s pilgrimages and teachings’, ১৯১৯-এ রচিত ‘Shivaji and his Times’, ১৯২২-এ রচিত ‘Nadir Shah in India’, ১৯৪০-এ রচিত ‘The House of Shivaji’ এবং চার খণ্ডে সমাপ্ত তাঁর আর এক মহাগ্রন্থ ‘The Fall of Mughal Empire’-এ। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা কেন্দ্রীয় ঘটনাকেন্দ্রিক ইতিহাস রচনার প্রবণতার কারণেই অনেক সময় অর্থনৈতিক বা  সামাজিক ইতিহাসের ব্যখ্যায় তাঁর কিছু খামতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই খামতি থাকা সত্ত্বেও ‘Studies in Mughal India’, ‘Studies in Aurangzib’s reign’, ‘Mughal Administration’ প্রভৃতি গ্রন্থে ভূমি রাজস্ব বা প্রাদেশিক শাসন কাঠামোর মতো বিষয়েও তিনি যথেষ্ট  আলোকপাত করেছেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে লিখেছেন ‘Economics of British India’। অর্থাৎ তিনি অর্থনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে উদাসীন ছিলেন না।

তাঁর সম্পর্কে সমালোচনা তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্পর্কে অনেক জায়গাতেই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। অনেকক্ষেত্রে তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসবেও সমালোচনা করা হয়। বিশেষ করে আওরঙ্গজেব প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন নিয়ে বলা হয়, তিনি সেখানে বাদশাহ আলমগীরের বহুমুখী চরিত্রের সঠিক মূল্যায়ন করেননি, বাদশাহের শাসনকালকে তিনি একপেশেভাবে দেখেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি কি পুরোপুরি ঠিক? অনেক জায়গায় তিনি আলমগীরের সমালোচনা করেছেন, আবার এও লিখেছেন— ‘‘এই শাসক বুদ্ধিতে, চরিত্রে উদ্যমে সে যুগের এশিয়ার শাসক-কুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন অসাধারণ পরিশ্রমী, নীতিবান, ন্যায়বান ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন।” তিনি শিবাজির যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনই শিবাজির স্থায়ী রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যর্থতার কথাও লিখতে ছাড়েননি। মুঘল সেনার নৃশংসতার কথা যেমন লিখেছেন, তেমন মারাঠা বর্গি বাহিনীর নৃশংসতার কথাও লিখেছেন। তিনি বড় বেশি ব্যক্তির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন-একথাও বলা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ তিনি মুঘল অর্থনীতি বা সমাজের ফাটলের মধ্যে সন্ধান না করে করেছেন বাদশাহ আলমগীরের চরিত্রের মধ্যে।

নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার উপমহাদেশে আধুনিক ইতিহাস চর্চার প্রথম ব্যক্তি না হলেও অবশ্যই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় তাঁর বিশিষ্টতা একাগ্রতা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়কে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না, কারণ উল্লেখ্য গুণগুলি উদ্ভাসিত হয় তাঁর জীবনীর পরতে পরতে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version