গত সংখ্যার পর
একে একে মঞ্চে উঠে অনুষ্ঠান করে চলেছে যে যার। আগে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের আগ্ৰহটাই বেশি। তারা নাচ, গান, ছড়া, কবিতা এমনকি তাৎক্ষণিক অভিনয় করেও দেখাচ্ছে কেউ কেউ। তারাই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মধ্যমনি। দর্শক ও শ্রোতাদের হাততালির সঙ্গে তারিফও কুড়িয়ে নিচ্ছে এই কচিকাঁচার দল। মঞ্চের চারিদিকে ভিড় উপচে পড়েছে। গোটা গ্ৰামের মানুষ এমনকি বাড়িতে আসা আত্মীয় স্বজন ও কুটুমরাও এসেছে দলবেঁধে। একদিন এই মঞ্চেই গান গাওয়া, বাঁশি বাজানোর স্বপ্ন দেখতো সেদিনের ছোট্ট লখাই। মা বাবার হাত ধরে ছোটবেলায় লখাই আসতো এই চাটুজ্যে বাড়িতে। স্নান, খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা সবই করতো স্বাধীন ভাবে। এ বাড়ির ছেলে মেয়েরা তাকে ভীষন ভালোবাসতো।
তারজন্যও বইখাতা, খেলনাপাতি, পোশাক-আশাক এনে দিত ভালোবেসে। লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি লখাই। তবুও মাধ্যমিক পর্যন্ত টেনেটুনে চালিয়েছে সে। খুব একটা আগ্ৰহও ছিলনা তার। শুধু মাঠঘাট ,নদীনালা, পাহাড়, ডুংরিতে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগতো। পাখি ও পাখির ছানাদের ভীষন ভালোবাসতো। আর ছিল নদী পুকুরে মাছ ধরার তীব্র নেশা। কিশোর বয়সে অদম্য জিদ চেপেছিল বাঁশি বাজানোর। তাঁর কোনও শিক্ষাগুরু ছিল না। পাড়ার বিশুদাদু যাত্রাদলের বাঁশিদার ছিলেন। আর গেনু দাদু ছিলেন বায়েন। বিশু দাদুর কাছে সামান্য তালিম নিয়ে বাকিটা শুনে শুনে গানের সুর তুলেছে লখাই। একদিন পরখ করেছিল তাঁর বিশু দাদু। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে- “একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…” গানটি শুনিয়েছিল লখাই। দাদু তাঁকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করেছিল। একটা নতুন দামি বাঁশি উপহার পেয়েছিল দাদুর কাছ থেকে। তার এই শিক্ষা লাভের পিছনে ছিল নগর বাউল, সাধু ফকির কিম্বা বহুরূপী আর পটুয়াদের অবদান। তাদের পিছু পিছু গানের টানে চলে যেত বহুদূর অবধি। গভীর মনোযোগ সঞ্চার করেছিল এভাবেই।
বাড়ির মেয়ে বউদের মঞ্চে ডাকার মাঝে লখাইয়ের নাম ঘোষনা করলো রুদ্র। সঞ্চালনা বা ঘোষকের ভূমিকায় রুদ্র শেখরের যথেস্ট দখলদারি ও মুন্সিয়ানা আছে বলে লখাইয়ের ধারণা। গ্ৰামে এলে তাঁরা হরিহর আত্মা হয়ে যায়। নাম ডাকতেই অগত্যা বাঁশি দুটো বগলদাবা করে মঞ্চে উঠলো লখাই। তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিল একটি ছোট্ট মেয়ে- দীয়া। উত্তরীয় পরিয়ে দিল খেয়া নামের আর একজন ছোট্ট মেয়ে। রুদ্র লখাইয়ের বাঁশি বাজানো নিয়ে এক মিনিটের জন্য উপস্থাপনা করে দেয়। চোখে জল চলে এলো লখাইয়ের। মঞ্চের মাটিকে প্রনাম জানিয়ে সুর সংযোজন করল তার প্রানপ্রিয় বাঁশিতে। প্রথমেই একটি জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত লালন সাঁই এর- “জাত গেল জাত গেল বলে এ কি আজব কারখানা…” গানটি দরদ ও নিষ্ঠা দিয়ে শুনলেন সমবেত শ্রোতা। বাঁশি থামতেই বড় তরফের কর্তা বাবু একশো টাকার একটি কড়কড়ে নোট সেফটিপিন দিয়ে ফতুয়ায় সেঁটে দিলেন। ভরা মঞ্চে লখাই প্রনাম করতেই মাথায় আশির্বাদের হাত রাখলেন তিনি।
এবার লখাই পর পর সুর তুলে চললো- কীর্তনাঙ্গ থেকে পদাবলী, প্রভাতী গান। শ্যামা সঙ্গীত থেকে নজরুল গীতির সুরে বাঁশি বাজিয়ে চললো। মঞ্চের কাছাকাছি সবার সঙ্গে বসে ছেলের বাঁশির সুর শুনে মোহিত হয়ে গেল। অজান্তে দরদর করে দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে চলেছে সেই আনন্দাশ্রু। হয়তো তার বাবাও একাত্ম হয়ে শুনে চলেছে লখাইয়ের বাঁশির সুর।
চলবে