যিনি হতেই পারতেন বাংলার স্বদেশী যুগের অন্যতম বিপ্লবী কিম্বা বামপন্থী দলের হোলটাইমার। বলাই বাহুল্য শেষমেশ ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বেশ কয়েক বছর জেলেও থাকতে হত।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিক্রমপুরের সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে গেলেন ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! তাঁর নিজের ভাষায়, ‘‘ছিলাম ‘বাঁড়ুজ্জে’, হয়ে গেলাম ‘ভাঁড়ুজ্জে’!’’ বাবা বিক্রমপুরের বিখ্যাত মাস্টার জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতিদেবী ছিলেন সিনিয়ার কেমব্রিজ পাশ করা বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় মহিলা স্কুল ইন্সপেকট্রেস, তাঁরও বিখ্যাত বংশ; সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া।
আজীবন কনভেন্ট স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তা স্বত্বেও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ভানু স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ছিলেন প্রখর রাজনীতি সচেতন। যখন তাঁরআট-দশ বছর বয়েস তখনই তিনি ‘গুরু’ মানতেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে। বুকের আড়ালে নিষিদ্ধ বই, টিফিন বক্সে রিভলভার লুকিয়ে নিয়ে জায়গা মতো পাচার করতেন। সাম্যকে নিজের সাইকেলের পিছনে বসিয়ে দীনেশ শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চড়কি পাক দিতেন। বিদেশি সিনেমা দেখাতেন, বুঝিয়ে দিতেন সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য। শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গান। ভানুও তাঁর দীনেশদার জন্য ঢাকার টাঙাওয়ালা কুট্টিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আনতেন পুলিশের গতিবিধির খবরাখবর।
দীনেশ গুপ্তের সূত্রেই কিশোর ভানুর আলাপ হয়েছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আন্দোলনের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহ এবং অলিন্দ যুদ্ধের আর এক যোদ্ধা বিনয় বসুর সঙ্গে। এমন করেই গানে-গল্পে পোড় খেয়ে উঠেছিল ভানুর স্বদেশী চেতনা। তারপর বিনয় আর বাদলের সঙ্গে মিলে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করলেন দীনেশ। হয়ে উঠলেন অলিন্দ যুদ্ধের মরণজয়ী নায়ক। ব্রিটিশের হাতে মৃত সেই অসমসাহসী যুবকের স্মৃতি চিরকাল বেঁচে রইল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুকে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতি বছর ভানু উপস্থিত হতেন দীনেশের শহীদ স্তম্ভের কাছে। শ্রদ্ধা নিবেদন করে চুপ করে বসে থাকতেন কিছুক্ষণ।রাইটার্সের অলিন্দ যুদ্ধে বিনয়-বাদল-দীনেশ শহীদ হওয়ার পর জড়িয়ে পড়েন ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’র কাজে।
মুন্সিগঞ্জের সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল শেষ করে সাম্যময় আইএ পড়তে এলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তখন কার্যত চাঁদের হাট। বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, কবি জসীমউদ্দিন, মোহিতলাল মজুমদার, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো শিক্ষকদের স্নেহ আদায় করে নিতে সাম্যর সময় লাগলো না। সাম্য দীর্ঘদিন কলেজে অনুপস্থিত। শিক্ষক জসিমউদ্দিন প্রিয় ছাত্র সাম্যকে ডেকে বললেন এবার আর পরীক্ষা দিতে দেবেন না। শুনে ছাত্র শিক্ষক জসিমউদ্দিনকে বললেন, “আমাকে পরীক্ষায় বসতে না দিলে রেডিওতে আর আপনার কবিতা পড়ব না”। সেই সময়সাম্য বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা রেডিওতে ঘোষক ছিলেন। ছাত্রের মুখে এমন কথা শুনে হা হা করে হেসে ফেলেছিলেন জসীমউদ্দিন।
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সত্যেনদা বলে ডাকার অধিকার ছিল একমাত্র তাঁরই। ঢাকায় বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর বাড়িতেই ভানুর কৌতুক-কথনের সূচনা। তাঁর জন্মদিনে দেখা করতে আসতেন বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীরা। সেই সমাবেশে সাম্যময়ের ডাক পড়ত কমিক বলার জন্য। সাম্যর প্রতি সত্যেন বসুর স্নেহ শেষ দিন পর্যন্তঅটুট ছিল। ভানু যখন বিখ্যাত চিত্রতারকা, কিন্তু ১ জানুয়ারি মাষ্টারমশায়ের জন্মদিনে ঠিক হাজির হয়ে যেতেন ঈশ্বর লেনে। বিজ্ঞানী সত্যেন বলতেন, “দেখেছো উষা (উষাবতী বসু) কেউ মনে রাখেনি…অথচ সাম্য কিন্তু কোনদিন ভোলেনা।”সে কারণেই প্রবীণ মাস্টারমশাই ডেকে পাঠাতেন তাঁর এই স্নেহের ছাত্রটিকে। বলতেন, ‘মাথা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আমার, একটু রস ঢেলে দিয়ে যা…।
১৯৪১ সালে, যখন সাম্য বিএ পড়ছেন, কোনও এক ব্রিটিশ ইনফর্মার অনুশীলন সমিতির হাতেখুন হয়। সে দলের পাণ্ডা ছিলেন উনি। ফলে হুলিয়া জারি। গ্রেফতারি এড়াতে ঢাকা ছাড়তে হল তাঁকে। গাড়ির পিছনের সিটের নীচে শুয়ে চলে এলেন কলকাতায়। কলকাতায় আসার পর শুরু হল নতুন জীবন। আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। কলকাতায় অভিনয়শিল্পী হিসাবে ভানুর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৬ সালে, চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যের ভূমিকায়। ওই বছরই বিয়ে করলেন বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিয়ের পরেই প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ এল। ১৯৪৯ সালে ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ১৯৫১ সালে ‘বরযাত্রী’, ১৯৫২ সালে ‘পাশের বাড়ি’ জনপ্রিয় হয়। ১৯৫৩ ‘মহারাজ নন্দকুমার’, ‘লাখ টাকা’ তবে ওই সময় মুক্তি পাওয়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ভানুকে। এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পর পর সাফল্য পান ওরা থাকে ও ধারে,ভানুপেল লটারী, গল্প হলেওসত্যি। হিন্দি ছবি ‘বান্দিস’, ‘এক গাঁও কি কাহানী’ তে অভিনয় করেন। কিন্তু মুম্বই-এ অফার নিতে কুণ্ঠা ছিল! তার একমাত্র কারণ এই শহর কলকাতা, আর তাঁর পরিবার।গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’র অফার ছেড়েছেন। কোনওক্রমে পরিচালক সত্যেন বসুর ‘বন্দিস’ বা হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’ করেছেন, তা’ও বন্ধুর আব্দারে।ফিরিয়েছেন বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকদের অনুরোধ।
জড়িয়ে ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে। লাল-হলুদ জার্সি মাঠে নামলে ভানু গ্যালারিতে থাকবেনই। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্যছিলেন, ম্যাচের আগে শচীন দেববর্মনের মতো বিশিষ্ট ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আপ্যায়ণের ব্যবস্থা, সদস্যদের কার্ড চেক করে গ্যালারিতে ঢোকানো- সব কিছু করেছেন ভানু।চল্লিশের দশকের শেষ ভাগে পুববাংলা থেকে তখন দলে দলে উদ্বাস্তু আসছে। মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ‘ইস্টবেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ তাঁদের সাহায্য করতে সীমান্তে, স্টেশনে শিবির গড়ছে। শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত এক করে কাজ করছেন। সেই দলে ছিলেন ভানু। যখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী অনন্ত সিংহ জেলে, বাড়ি থেকে প্রায়ই খাবার নিয়ে যেতেন। আবার অন্যায় দেখলে বেপাড়ায় গিয়েও গুন্ডাদের শায়েস্তা করেছেন ভানু।
2 Comments
পথের পাঁচালি দেখে আনন্দের চোটে কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রি করছেন.. অবাক হয়ে মজা করে বলেছেন “ব্যাঙ যে মইরা গেলে চিত হইয়া থাকে সত্যজিৎ রায় শহরের লোক হইয়া জানল কি কইরা..!”
কিছু না জানা তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ।