দুর্গা বহু শক্তিদেবীর রূপভেদ। তাঁদের একেক জনের গায়ের রং একেক রকম। কৃষ্ণনগরের নাজিরা পাড়ার চট্টোপাধয়ায় পরিবারে যে দুর্গা পুজো হয় তার গায়ের রঙ নীল। আজকের কথা নয়, তিনশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে নাজিরাপাড়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নীল দুর্গা পুজোর বয়স। শরিকি দ্বন্দ্বে বনেদি বাড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। ভাগ হয়েছে পুজো। এখন পাশাপাশি দুই বাড়িতেই দুর্গা পুজো হয় আর দু-বাড়িরই দুর্গার রং নীল।
প্রায় সব জমিদার বা বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর মূর্তি সেই বাড়ির ঠাকুরদালানে নির্মিত হয় আর তা গড়ে থাকেন বংশানুক্রমে কোনও না কোনও মৃৎশিল্পী।চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার রামরাইন গ্রামে। সেখানেও পুজো হত। তবে গোড়া থেকেই এই দুর্গাপুজোর মূর্তি নীল রঙের ছিল না। এখানেও বংশ পরম্পরায় গল্প চালু রয়েছে।
প্রবীন মৃৎশিল্পী একটানা কয়েকদিন কাজ করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বিশ্রাম নেওয়ার মতো হাতে সময় তো নেই, বরং রাত জেগে কাজ করতে পারলেই ভাল। মাত্র কয়েকদিন পর দেবীর বোধন। রাত জেগে কাজ করে চলেছেন সেই বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী। এদিকে তেলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় হ্যারিকেনের আলোও নিভু নিভু। ক্লান্তিতে তাঁর চোখের পাতা মাঝেমধ্যেই বুজে আসছে। কিন্তু সেই রাতেই মূর্তির গায়ের রঙ সেরে ফেলতে হবে। সেই রঙ শুকিয়ে গেলে তবেই অন্য রঙের কাজে হাত দেওয়া যাবে। রাত জেগে নিভে আসা হ্যারিকেনের আলোতেই তিনি কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।
ওদিকে রাত ফুরিয়ে আগামীর আকাশ লালচে হয়ে উঠছে, দূরে পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করেছে, এমন সময় পূবের কোন থেকে এক চিলতে ভোরের নরম আলো এসে পড়ল মূর্তির উপর। হ্যারিকেনের আলো নিভে গিয়েছে। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর আর ঘুমে জরানো চোখে চমকে উঠলেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী। সারারাত ধরে তিনি মূর্তির গায়ে যে রং করেছেন সে রঙ তো পুরোপুরি আলাদা। দেবী এমন অপরাজিতা নীল হলেন কি ভাবে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলেন তিনি। এখন উপায়। নতুন করে রং করার যে সময় নেই। মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল খবর। রং দেখে মুষড়ে পড়লেন সকলেই। এমন সময় বাড়ির কর্তা চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায় হাজির হলেন। জানালেন, চিন্তার কিছু নেই। রাতে দেবী তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন, যেন অপরাজিতা রঙেই দেবীর পুজো করা হয়। সেই থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে অপরাজিতা রঙের দুর্গা পুজো হচ্ছে। গোটা কৃষ্ণনগর বাসীর কাছে তিনি নীল দুর্গা।
নদিয়া জেলায় নীল দুর্গার পরই এসে পড়ে কালো দুর্গার কথা। হাঁসখালির বাহিরগাছি গ্রামে যে দুর্গাপুজো হয়, সেই দেবী মূর্তির গায়ের রং কুচকুচে কালো। তবে এ পুজো বনেদি বাড়ির নয় আশ্রমের। যেটি এলাকায় শান্তি আশ্রম বলে পরিচিত। একসময় এই পুজো ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলগ্রামের জমিদারবাড়ির। ওই বাড়ির বংশধর সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়ে বাহিরগাছিতে এসে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দুর্গা পুজো শুরু করেন। পাবনার স্থল গ্রামের দুর্গা মূর্তির রংও হত কুচকুচে কালো। সেখানেও ভুল করে কালো রং করে ফেলার গল্প, প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো শান্তি আশ্রমের কালো দুর্গা পুজোর বয়স।
কালো রঙের দুর্গা সাধারণত ভাবা যায় না কারণ এদেশে তাঁর পুজো প্রায় নেই বলা যায়। তবে দক্ষিণ ভারতের দুর্গা মারিয়াম্মার গাত্রবর্ণ কালো। এই বাংলায় কালো দুর্গার পুজো হয় বেলেঘাটার ভট্টাচার্য বাড়িতে। যদিও এই পরিবারে কালো রঙের দুর্গার পূজা শুরু হয়েছিল পূর্ববঙ্গের স্থলবসন্তপুরে। নাটোরের রানি ভবানীর আমলে।ভট্টাচার্য পরিবার ১৯৪৭ সালে ওপার বাংলা থেকে আসানসোল চলে আসে। সেখানেও কালো দুর্গা পুজো হত। তারপর স্থান পরিবর্তন করে কখনও দুর্গাপুর, কখনও সল্টলেকে তাদের ঠিকানা হয়েছে। কিন্তু সেসব জায়গাতেও পরিবারের সদস্যরা পারিবারিক পূজো চালিয়ে গিয়েছেন। বছর কুড়ি ধরে বেলেঘাটার রামকৃষ্ণ নস্কর লেনের ফ্ল্যাট বাড়ির নীচে ফাঁকা জায়গায় পুজো হচ্ছে। স্বাধীনতা, দেশ ভাগ বহু কাল আগেই হয়েছে। সমাজে বহু পরিবর্তনও হয়েছে। কিন্তু এই পুজোয় কোনওদিনই কোন বাধা পড়েনি। হরিদেব ভট্টাচার্য কালো যে কালো দুর্গা পুজোর শুরু করেছিলেন, সেই ঐতিহ্য পদ্মা পেরিয়ে এখন বইছে গঙ্গা তীরেও।
শুধু বেলেঘাটায় নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং এলাকাতেও কালো দুর্গার পুজো হচ্ছে প্রায় ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে। এখানকার পুজো আরেক ভট্টাচার্য পরিবারের। এই ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গার মুখের রং কালো। প্রায় ৪৩২ বছর আগে এই পুজো শুরু হয়েছিল ঢাকার বিক্রমপুরের বাইনখাঁড়া গ্রামে। এখন আর ওই পুজোয় সেই আড়ম্বর নেই ঠিকই তবে বনেদিয়ানা রয়ে গিয়েছে। কথিত আছে, বাইনখাঁড়া গ্রামে পুজো শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই অঘটন ঘটেছিল। পরিবারের বর্তমান সদস্যদের কথা অনুযায়ী, তখন দুর্গা মন্দিরের পাশে ছিল মনসা মন্দির। পুরোহিত মনসা পুজো সেরে দুর্গাপুজো করতে এলে একটি কাকও সে সময় উড়ে এসে বসে। এরপরই কাকটি মনসা মন্দিরের ঘিয়ের প্রদীপের সলতে নিয়ে উড়ে যায়। কিন্তু কোনওভাবে সেটি দুর্গা মন্দিরের শনের চালে পড়ে যায়। আর তাতেই পুড়ে যায় দুর্গা মন্দির ও প্রতিমা।পুজোর মধ্যে এমন ঘটনায় বাড়ির প্রবীণরা পুজো বন্ধ রাখেন। এক রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন পরিবারের তৎকালীন গৃহকর্তা রামকান্ত ভট্টাচার্য। ওই পোড়া রূপেই যেন তিনি পুজো পান। দেবীর আদেশ পাওয়ার পর থেকে পোড়া মুখ ও ঝলসানো শরীরের মূর্তিতেই পুজো চলছে।