অয়ন ঘোষ

একটা কথা আছে না, a forest bird can never be caged. বিষয়টা আমার ক্ষেত্রেও অনেকটা একইরকম। শহুরে ব্যস্ত জীবনের খাঁচায় নিজেকে বন্দি করে রাখলেও শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকি কখন দরজাটা এক মুহুর্তের জন্যে খোলা পাব। ঠিক এইরকম এক সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই আবার বেড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা তিন ভ্রমণ পিপাসু বন্ধু নতুনের খোঁজে। এবারের গন্তব্য, বিজনবাড়ী। দার্জিলিং জেলার প্রাচীনতম গ্রাম এই বিজনবাড়ীতে তেমন কিছু দেখার না থাকলেও এখানকার রঙ্গিত নদীর অপার সৌন্দর্য আপনার মনকে মাতিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। তারিখটা ২৮শে জানুয়ারি ২০২১। শিয়ালদহ থেকে আমাদের ট্রেন ছিল রাত ১১.২০ মিনিটে। সেই মত তৈরী হয়ে লোকাল ট্রেন ধরে পৌঁছে গেলাম শিয়ালদহ ষ্টেশনে সময়ের বেশ কিছুক্ষণ আগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে চলে এলো আমার বাকি দুই ভ্রমণসঙ্গী কৌশিক দা আর সৈকত।

শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ছেড়ে নির্ধারিত সময়ে সকাল ৯.১০ মিনিটে আমাদের পৌঁছে দিল নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে। বাইরে বেরিয়ে যথারীতি গাড়িওয়ালাদের হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। তবে আমরা বদ্ধ পরিকর ছিলাম যে রিজার্ভ গাড়ির পরিবর্তে শেয়ার ট্যাক্সিতে যাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ। অটো ধরে সোজা চলে এলাম শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ড। ভাড়া নিল জন প্রতি ২০ টাকা। সেখান থেকে জন প্রতি ২০০ টাকার বিনিময়ে শেয়ার ট্যাক্সি নিয়ে পাড়ি দিলাম সোজা দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে। এখানে একটু বলে রাখি যদি আপনি সম্পুর্ণ গাড়ি ভাড়া করেন, তবে বড় গাড়ীর ক্ষেত্রে বিজনবাড়ীর ভাড়া পড়বে ৪৫০০ – ৫০০০ টাকা আর ছোট গাড়ীর ক্ষেত্রে তা হবে ৩৫০০ – ৪০০০ টাকা। আর শেয়ারে গেলে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং ২০০টাকা আর সেখান থেকে বিজনবাড়ী ১৫০ টাকা অর্থাৎ জন প্রতি ৩৫০ টাকায় আপনি পৌঁছে যেতে পারেন বিজন বাড়ি। আমরা যেহেতু মাত্র তিনজন ছিলাম তাই আমরা শেয়ারের পথ টাই বেছে নিয়েছিলাম। কিছুটা সময় সাপেক্ষ হলেও সাশ্রয়ী।

যানজট কাটিয়ে আমরা যখন আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছলাম, ঘড়ীর কাঁটায় তখন প্রায় বিকেল ৪টে। শেয়ার গাড়ী আমাদের বিজনবাড়ী বাজারে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে হোটেলের গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে গেল। এখানে আমাদের ডেস্টিনেশন ছিল রেলিং রঙ্গিত রিভার রিসর্ট যা এখানকার অন্যতম বিখ্যাত একটি হোটেল। সারাদিন ধরে জার্নি করার পরে আমরা প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু লাঞ্চ সেরে রঙ্গিতের ধারে গিয়ে বসতেই খরস্রোতা নদীর স্রোতের শব্দে ও চারিদিকের নিস্তব্ধতায় সমস্ত ক্লান্তি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। মনে হল যেন নতুন প্রান ফিরে পেলাম। সেদিন সন্ধ্যায় আর বিশেষ কোথাও যাইনি আমরা। ঘরে বসেই ৩ বন্ধু গল্প করে কাটিয়ে দিলাম।

আগেই বলেছি বিজনবাড়ীতে যদি দেখার কিছু থাকে তবে তা হল শুধুমাত্র এই রঙ্গিত নদী। নানান জায়গায় নানা রুপ ধারন করেছে এই স্রোতস্বিনী। সেই রুপ অনুভব করতেই নদীর পাড় ধরেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম আমরা তিনজন। রেলিং রঙ্গিত রিভার রিসর্টের মূল আকর্ষন হল তাদের এই একমাত্র কটেজ যার বারান্দাটা একদম নদীর সামনে। এই রুম পেতে হলে আপনাকে অনেক আগে থেকে বুকিং করতে হবে। আমরা প্রায় ২ মাস আগে বুক করেও মাত্র একদিনের জন্য এই রুমটা পেয়েছিলাম।

থাকা-খাওয়া বাবদ প্রতিদিন জনপ্রতি আমাদের ভাড়া লেগেছিল ১৫০০ টাকা। তবে এটা ফিক্সড রেট নয়। সময় এবং চাহিদা বিশেষে দাম ওঠা নামা করে। সারাদিন রঙ্গিতের আশেপাশেই নানাভাবে আমরা আমাদের নিজেস্ব সময় কাটিয়েছি। সত্যি এরকম একটা জায়গা মনকে শান্তি দেয়। শক্তি দেয় ফিরে গিয়ে আবার সেই ব্যস্ত জীবনে লড়াই করার। সন্ধ্যে হতেই তৈরী হয়ে গেল আমাদের বন ফায়ার আর বারবিকিউ। আমরা রুম থেকে বেরিয়ে আগুনের সামনে গিয়ে বসলাম। এই বন ফারার আর বারবিকিউ এর রেট হল প্রতি ১ কেজি চিকেনের জন্য ৫০০ টাকা। আমাদের তিন জনের জন্যে ১ কেজিই যথেষ্ট ছিল।

এখানকার খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমাদের অন্তত কোনও কমপ্লেন নেই। রান্না খুবই সুন্দর। বাসমতী চালের ভাত, ডাল, তরকারি, দুপুরে ডিম আরে রাতে চিকেন। এছাড়া ব্রেকফাস্টে কোনদিন লুচি তরকারি তো কোনদিন চাউমিন, সন্ধ্যে বেলা চা এর সাথে ভেজ পোকড়া। স্বাদে গন্ধে সবকটি খাবারই অতুলনীয়। তবে এখানকার সবথেকে বড় সমস্যা হল যে এখানে ইলেক্ট্রিসিটির খুব সমস্যা। মাঝে মধ্যেই কারেন্ট চলে যায়। যদিও রিসর্টের নিজেস্ব জেনারেটর আছে তবুও সমস্যা বলতে এই একটাই।

এই ছিল আমাদের দেড় দিন ব্যাপী বিজনবাড়ী ভ্রমণের ইতিকথা। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা একটি ছোট গাড়ি ভাড়া করে চলে এলাম ওয়েস্ট সিকিমের জোড়থাং। সেখান থেকে জন প্রতি ২২০ টাকার বিনিময়ে আমরা চলে এলাম শিলিগুড়ি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আমাদের ট্রেন ছিল রাত ৮টায়। বিজনবাড়ী উপভোগ করার সবথেকে ভালো সময় হল বর্ষার পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মার্চ। শীতকালে গেলে আপনি ঠান্ডাটাও উপভোগ করতে পারবেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version