এক
ভ্রমর বুঝতে পারে অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে৷ নিয়তিকে হার মানানোর লড়াই লড়তে হবে তাকে৷ এতদিনের ধারণাগুলো ক্রমেই কঙ্কালসার হয়েছে৷ স্বপ্ন বেদনার বর্ণহীন, রক্তহীন, পুঁজিহীন ক্ষত তাকে গ্রাস করেছে৷ সে বুঝতে পারে মানুষ জীবনের এক অগোচর সত্য৷ শঙ্খ আর করাতে অবৈধ মিলনেই এ মানব জন্ম৷ তাই দুঃখ, কষ্টবহন করে যাওয়া অভ্যেস করে নিতে হয়৷ রক্তরাঙা সব অপমানকে সচেতনভাবে ভুলতে হয়৷ পার হওয়া রেলব্রিজ, উড়ালপুল, মায়াবী হলুদ ট্যাক্সি, ঠোঁটে ঠোঁট রাখা প্রেমের ব্যারিকেড, একশো ঘুঙুরের গাঁথনি, হাতের তালিতে বোলবলা -সবই একটা সময় দুঃখ দিয়ে যায়৷ ‘বিষ দাও অমৃত চাই না’৷ এই বিষ চাওয়ার মধ্যে মাছে-ভাতে বাঙালি যেন মহান হয়ে, শহিদ হয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ খোঁজে৷
সব বিসর্জনের পদাঘাত বুকে নিয়ে মধ্যরাতে চুল খুলে একা বসাই যেন মোক্ষলাভ৷ রক্তবীজগুলি অনন্ত তোমার দিকে চেয়ে থাকলেও তুমি ধমক দিয়ে তাদের সিধে করতে পারবে না৷ কারণ তুমি তো জেনে এসেছ, এই বিশ্বের পথে যেতে যেতে সব ভালবাসা কুড়িয়ে জীবনকে আনন্দের সৌরভে ভাসাতে হবে যে৷ সেখানে কোনও বাদানুবাদ, অপ্রিয় সত্য বলা, নিজের সোচচার হওয়ার জায়গা নেই৷ বরং তোমার সব রাগ, অভিমান, অপছন্দ, বিদ্রোহী মনকে দেওয়ালে লটকে দাও জন্ম-অপরাধীর কবিতার মতো৷ বার বার তোমাকে মনে রাখতে হবে তুমি সামাজিক জীব, তোমার পূর্বপুরুষরা কখনও নিয়মের বাইরে গেলেও, তোমার আশপাশের লোকজন একেবারে সোজা রাস্তায় ‘ডেলি ডিউটি’ করে টিভি-ফ্রিজ-আলমারিতে সুখের সংসার পেতেছে৷ তাই কোনও প্রশ্ন করো না, তর্ক করো না, আড়চোখে তাকিও না৷ বেশি লম্ফঝম্ফের প্রয়োজন নেই৷ ‘একে ওকে নষ্ট করে চলে গেল প্রেম। যদি বা যাবার ছিলতবে কেন থেমেছিল সহসা এখানে? পৃথিবী উত্তাল আজ প্রেমভ্রষ্ট মানুষের ভিড়ে।’ তবু বিনিসুতোয় বাঁধা জীবনের একটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সমাজ যে পথ দেখাচ্ছে, সেই পথেই হাঁটো৷ নো চিন্তা ভেন্ডি ভাজা৷ ভ্রমর পারেনি৷ ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রাখতে পারেনি জীবনের সব কমা, ফুলস্টপ৷ তাই তার ঝকঝকে অ্যাফেয়ারের স্রোত এখনও লাফায় তার শরীরে৷ ঢেউয়ের পর ঢেউ তাদের চরণ ছুঁয়েই চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, ডোবাতে পারেনি৷ বরং তারা যেদিন সম্মত হয়েছে, সেদিনই চৈতন্যদেবের মতো হেঁটে গিয়েছে মাঝ সমুদ্রের দিকে৷ তারপর প্রবল তরঙ্গ অভিঘাতে তারা হাত ধরাধরি করে নেমে গিয়েছে কাঙিক্ষত জলে৷ আর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি সাবধানী লোকজন? তারা ভারি আনন্দ পেয়েছে৷ তাদের দৃষ্টিতে যতটুকু দেখা সম্ভব তারা সেটুকুই দেখেছে৷ হাততালি দিয়ে বলল, “বেশ হয়েছে৷ সীমা ভাঙার উত্সবে নেমে ভ্রমর ডুবে মরলি৷” গল্পটা এখানেই শেষ নয়৷ ভ্রমর এবং তার ঝকঝকে অ্যাফেয়ার মাঝ সমুদ্রে গিয়ে দাঁড়াল৷ সিদ্ধান্ত নিল, জীবনের পলকা ডানায় শিকল পরাবে তারা৷ ধূর্ত রাতের পর্দা সরিয়ে তারা আনবে অবাস্তব দিন৷ ঠিক সেই সময় নিয়তি নতজনু হয়ে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে এসে দাঁড়াল৷ ভ্রমরও তার ঝকঝকে অ্যাফেয়ার মুঠো মুঠো ভালবাসায় ভরে দিল নিয়তির ভিক্ষাপাত্র৷ নিয়তির বাঁকে মৃত্যু দাগ নিয়ে গেল ভ্রমরের ঝকঝকে অ্যাফেয়ারকে৷ সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে, হোমকুণ্ডের আগুনের তাপ নিতে নিতে জীবনের অনিবার্য এক সত্য উপলব্ধি করল কোমল মেয়ে ভ্রমর৷ অভিজ্ঞতা হল ভিত৷ কল্পনা হল উড়ান৷ আর দুয়ে মিলে হয় ভ্রমর পেল ভালবাসার রং৷
1 Comment
ঝরঝরে গদ্য, পড়ে ভাল লাগলো।