একটি ছেলে আপন মনে বসে বসে গান গাইছে, সেই সময়ে তখনকার বড় ওস্তাদ গান শেখানোর জন্য পাশের বাড়ির দরজায় এসে হাজির। ছেলেটির গান শুনে তিনি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গানটি শুনে তিনি সে বাড়ির গৃহর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘লড়কা হোনহার হ্যায়, কিসকা শাগির্দ হ্যায়?’’ গৃহকর্তা জানানোর পর ওস্তাদ বললেন, ‘‘ইয়ে তুমহারে বস কি বাত নহি।’’ সেই সুযোগে ওস্তাদকে অন্যজন জিজ্ঞেস করলেন ‘‘খান সাহেব, আপনি কি ওকে শেখাবেন?’’ এর উত্তরে ওস্তাদ বলেছিন, ‘‘কিউঁ নেহি?’’ এরপর একদিন সেই ওস্তাদ যখন রিকশা থেকে নামছেন, তিনি দেখলেন সেই ছেলেটি বাড়ির রকে বসে পা দুলিয়ে কেদারা গেয়ে চলেছেন। ওস্তাদকে দেখে ছেলেটি গান থামাতয়ে গেলে ওস্তাদ তাঁকে ইশারায় গান চালিয়ে যেতে বললেন। এর পরে ছেলেটি একটানা চোদ্দো বছর সেই ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। ছেলেটির ডাকনাম ছিল ‘কালো’। আসল নাম ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় আর সেই ওস্তাদ হলে বদল খান। কালোকে তিনি ‘কাল্লু’ বলে ডাকতেন।
গত শতকের তিরিশের দশকে মেগাফোন কোম্পানির জে এন ঘোষ এবং কবি অজয় ভট্টাচার্যের অনুরোধে ভীষ্মদেব বাংলা গান রেকর্ড করতে রাজি হয়েছিলেন। একদিন ভীষ্মদেব অজয় ভট্টাচার্যকে জিঙ্গাসা করলেন, ‘গান লেখা হয়ে গিয়েছে?’অজয় ভট্টাচার্য দু’টি লেখা গানের কাগজ তাঁর হাতে দিতেই ভীষ্মদেব বললেন, ‘তাহলে রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করুন’। শুনে সকলেই খুব অবাক হলেন! গান দু’টি না পড়েই এমনকি সুর না করেই তিনি রেকর্ড করার কথা বলছেন। যাই হোক রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা হল। রেকর্ডিং রুমে ঢুকতে ঢুকতে ভীষ্মদেব গান দু’টিতে এক বার চোখ বোলালেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই সুরও হয়ে গেল, তারপর রেকর্ডও করে ফেললেন- ‘ফুলের দিন হল যে অবসান’ এবং ‘শেষের গানটি ছিল তোমার লাগি’। রেকর্ডিং-এর সময়ে উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল। সব দেখে শুনে কাজী নজরুল ভীষ্মদেবকে বললেন, ‘‘তুমি ভগবান না ভূত?’’ নজরুল ভীষ্মদেবের একজন গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁর ইচ্ছেতেই ভীষ্মদেব মেগাফোন কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক ও প্রশিক্ষকের পদে যোগ দেন।
ভীষ্মদেবকে নিয়ে সত্য মিথ্যা বহু গল্প আছে। ভীষ্মদেব কাফি-ভৈরবীতে ‘ভলা মোরা মনভাতি মুরলি বাজাই’-এই ঠুমরিতি রেকর্ড করার পর ভেবেছিলেন একই সুরে একটি বাংলা গান রেকর্ড করবেন। ইতিমধ্যেই শচীনদেব বর্মণ ওই গানেরই সুরে একটি বাংলা গান ‘জাগো মম সহেলি গো’ রেকর্ড করেন। সবাই ভাবলেন তাহলে আর হল না। কিন্তু ভীষ্মদেবও ভাবনা চিন্তা করে একটি রাগপ্রধান বাংলা গান মেগাফোন থেকে রেকর্ড করেন-‘যদি মনে পড়ে সে দিনের কথা’। গানটি রেকর্ড করার জে এন ঘোষ তাঁকে বললেন, অন্যান্য গানের তুলনায় এই গানটি অনেক হালকা চালের। উত্তরে একটু হেসে ভীষ্মদেব বলেছিলেন, ‘‘এই গানটিই বেশি চলবে।’’ পরবর্তীতে ‘যদি মনে পড়ে সে দিনের কথা’-র কালজয়ী বাংলা গান হয়ে গেল।
ভীষ্মদেব বাংলা তথা হিন্দুস্তানি রাগসঙ্গীত জগতে এক বিস্ময়। তাঁর গায়কিতে তিনি দুর্বারগতির তানবিস্তার করে যেমন অপ্রত্যাশিত চমক সৃষ্টি করতেন তেমনই তাঁর অনন্য সরগমে মুগ্ধ করতেন শ্রোতাদের। কেবল খেয়াল নয়, ঠুমরিতেও ছিল স্বকীয়তা। তিনি বাংলা রাগপ্রধান গানে এনেছিলেন নতুন এক ধারা। সম্ভবত তিনিই একমাত্র বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, যাঁকে সবাই ‘উস্তাদ’ সম্বোধন করতেন। বাংলা রাগপ্রধান গানে তিনি নতুন এক ধারার স্ফূরণ ঘটিয়েছিলেন। শোনা যায়, গানের আসরে ভীষ্মদেবের গানের পরে প্রায় কোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই মঞ্চে উঠে সঙ্গীত পরিবেশন করতে স্বস্তি বোধ করতেন না।
এক সময় ভীষ্মদেবের কর্মজীবন ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এক দিকে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী, অন্য দিকে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি এবং ফিল্ম কর্পোরেশনের সঙ্গীত প্রশিক্ষক ও পরিচালক। কিন্তু ভীষ্মদেব ছিলেন একজন সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর শিল্পী। সঙ্গীত ছাড়া কোনও কিছুই তাঁর উপরে প্রভাব ফেলত না। প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে তিনি ভাল রোজগার করলেও, তাঁর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না। প্রতিষ্ঠা, যশ, খ্যতিতে তাঁর মনে হয়তো এক অতৃপ্তি সৃষ্টি হয়েছিল, যা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি হয়তো মানসিক শান্তি পাচ্ছিলেন না। সেই শান্তির খোঁজেই তিনি পন্ডিচেরি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই ভেবে যে, সেখানে মানসিক শান্তির সঙ্গে নির্বিঘ্নে সঙ্গীতচর্চাও করতে পারবেন। কিন্তু তেমনটা হয়নি।