হিন্দি ছবির গানে তখন লতা, নূরজাহান, গীতা দত্তদের দাপট। সব ছবিতে তাঁরা গাওয়ার পর যেসব গান থাকতো সেগুলো দেওয়া হত তাঁকে। সোজা কথায় ‘বি’ বা ‘সি’ গ্রেডের গানগুলোই পেতেন তিনি। অথচ কন্ঠমাধূর্য কারো চেয়ে কম নয়। পণ্ডিত যশরাজ তাঁকে বললেন বাণিজ্যিক ছবির গান ছেড়ে ক্লাসিক্যাল গাওয়া শুরু করুন। কিন্তু সেটা করলে যে তিন সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া যাবে না। গান গাওয়া তো সে কারণেই।
গান গাইলে কন্ঠ যাতে লতা, নূরজাহান, শামসাদ বেগম বা গীতা দত্ত-র মতো না শোনায় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হত আশাকে। চেষ্টা করে স্বতন্ত্র একটা গায়কী ঠিক করলেন। তা সত্ত্বেও বলার মতো সুযোগ পেতে পেতে লেগে গেল ১৪ বছর।
১০ বছর বয়সে গেয়েছিলেন প্রথম গান। তার ৯ বছর পর একটি ছবিতে গান। একে একে বিমল রায়ের পরিনীতা, রাজ কাপুরের বুট পালিশ; রফির সঙ্গে ‘নানহে মুন্নে বাচ্চে’ গেয়ে কিছু শ্রোতার মন পেলেন। তবে দিলীপ কুমার-বৈজয়ন্তীমালার নয়া দৌড় ছবিতে ‘মাঙ্গকে সাথ তুমহারা’ গাওয়ার পর লোকে তাঁর নাম জানল। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত ক্যাবারে, বিশেষত হেলেনের নাচ মানেই তাঁর গান-এই ছিল পরিচয়।
এরপর ওপি নায়ারের সুরেই তাঁর জাত চেনা গেল। ‘নয়া দৌড়’-এ সাহির লুধিয়ানভির কথায় রফির সঙ্গে ‘মাঙকে সাথ তুমহারা’, ‘সাথী হাথ বাড়হানা’ আর ‘উড়ে যব যব জুলফে তেরি’ – এই তিনটি গান গেয়ে প্রথম বড় সাফল্য পেয়েছিলেন। তারপর ওয়াক্ত, গুমরাহ, হামরাজ, আদমি অওর ইনসান, হাওড়া ব্রিজ, মেরে সনম, এক মুসাফির এক হাসিনা, তুমসা নেহি দেখা, কাশ্মির কি কলিতে তাঁর কন্ঠের জাদু বোঝা গেল।
ওই সময় দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে কথা বন্ধ। একসঙ্গে ডুয়েট গাইতে গিয়ে আশাকে যাতে দেখতে না হয় তার জন্য দিদিলতাডান হাতে গানের খাতা নিয়ে মুখ সরিয়ে রাখতেন। আবার লতার ছোট বোন হিসেবে পেশাগত জীবনে কোনো সুবিধা পাননি আশা। সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে অনেক দিন কাজ করেননি লতা। এর সুবিধাও পেয়েছেন। নইলে কালা পানি, কালা বাজার, ইনসান জাগ উঠা, লাজবন্তি, সুজাতা এবং তিন দেবিয়া-র অসাধারণ কিছু গান একচেটিয়াভাবে গাওয়ার সুযোগ আশাজী পেতেন কিনা সন্দেহ।পারিবারিক জীবনে অশান্তি শুরু হওয়ায় সঙ্গীত জগত থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকেন গীতা দত্ত। সুযোগ যেমন পেলেন তেমনি নিজের মুন্সিয়ানা প্রমান করলেন কালা পানি, কালা বাজার, ইনসান জাগ উঠা, লাজবন্তি, সুজাতা এবং তিন দেবিয়া ছবিতে অসাধারণ গান গেয়ে।
ওই সুযোগ না পেলে উপমহাদেশের সঙ্গীত আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হতেন কিনা জানা নেই। হয়ত রাহুল দেব বর্মনের সংস্পর্শে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। তা না পেলেও উপমহাদেশের সঙ্গীতের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হতেনই। একটু হয়তো দেরি হতো। ওপি নায়ারের সঙ্গে রহস্যজনক কারণে দূরত্ব সৃষ্টির পর রাহুল দেব বর্মনের গানেই শুরু হয়েছিল আশা ভোঁসলের উত্থানের দ্বিতীয় ধাপ। অবশ্য রাহুল দেব বর্মনেরসহায়তায় আশাজী খুব তাড়াতাড়ি ওপরে ওঠার সিঁড়ি ধরেছিলেন- এমনটা না বলে বরং বলা ভালো, অশান্ত জীবনে রাহুল দেব বর্মনের মতো স্বামী এবং সুরস্রষ্টাকে পেয়ে একেবারে নতুন রূপে শ্রোতাদের সামনে হাজির হতে পেরেছিলেন।ক্যাবারে, রক, ডিসকো,গজল, ভারতীয় ক্লাসিক্যাল রাহুলের সুরে কী না গেয়েছেন তিনি। হিন্দি ছবির গানের মেহবুবা হলেন আশা ভোসলে।
শুরুর দিকে ভালো গানের জন্য হা-পিত্যেশ করতে হয়েছে তাঁকে। অথচ কত টাকা নেবেন তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ‘উমরাও জান’ ছবিটা করবেন কিনা তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছিল পরিচালক মুজাফ্ফর আলীর মনে। কম বাজেটের ছবি। অথচ ছবির গানগুলোর জন্য আশা ভোসলেকে তাঁর চাই-ই চাই। কিন্তু আশার চাহিদামতো টাকা দিতে পারবেন না বলে সরাসরি কিছু বলতেও পারছিলেন না। মেয়ে বর্শার সঙ্গে পরিচয় ছিল। আগু-পিছু না ভেবে ধরলেন তাঁকে। বর্ষা মা-কে শুধু বলেছিল, গানগুলি শুনে পছন্দ না হলে গেয়ো না। গান আর তার কথা শুনে আশাও না বলতে পারেন নি। আসলে এই গান গাওয়ার জন্যই সারা জীবন অপেক্ষা করেছিলেন আশা। কিন্তু তাতেও পরিচালকের সমস্যা মিটল না। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁর পছন্দ ছিল রেখাকে। কিন্তু টাকার অঙ্ক শুনে রেখা আগ্রহ দেখাননি। এই কথা শুনে আশা রেখাকে ফোন করে বলেছিলেন, উমরাও জান ছবির কাহিনী এবং গানগুলি শুনো, এতে তোমায় অভিনয় করতে হবে। আশার কথায় রেখাও রাজী হলেন। বাকিটা তো ইতিহাস।
একটা সময় ছিল যখন দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তুলনা এড়ানোর উপায় খুঁজতে হত আশাকে। কন্ঠ, গায়কী অন্যরকম রাখতে কী কসরত করেছেন সেটা না বললেও চলে। স্বকীয়তা খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই সঙ্গীত ভুবনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন। তারপর কেউই কিন্তু লতা, নূরজাহান, গীতা দত্ত বা অন্য কারো সঙ্গে তাঁর তুলনা করার কথা ভাবেন নি। বোদ্ধা শ্রোতা মাত্রই জানেন আশা ভোঁসলে অনন্যা, অতুলনীয়া। মুম্বই ফিল্মের গানের দুনিয়ায় তাঁর মনোপলির দিন তো কবেই শেষ হয়ে গিয়েছে তবু তিনি রোদ্দুরের মতোই রয়ে গিয়েছেন।
2 Comments
গনপতকে বিয়ে করায় আশার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন অভিমানী লতা। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে গনপত রাওয়ের সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত বনিবনা না হওয়ায় আশা নিজের আয়ের টাকা, নিজের টাকায় কেনা গয়নাগাটি সব ফেলে হেমন্ত আর বর্ষাকে নিয়ে এক বস্ত্রে চলে আসেন মায়ের কাছে। দিদি লতা মঙ্গেশকর তখন আর মুখ ফিরিয়ে রাখেননি।
মঞ্চে টানা দু ঘন্টা একটা রাগ পরিবেশন করতে চেয়েছিলেন। পণ্ডিত যশরাজ তাঁকে সব ছেড়ে ক্লাসিক্যাল গাইতে বলেছিলেন কিন্তু পরিবারের জন্য যে তা পারেননি সেই আফসোসও রয়ে গিয়েছে নিশ্চয়।