দ্বিতীয় পর্ব
রাঢ় বাংলার পূর্ব বর্ধমান জেলার অর্ন্তগত কালনা মহকুমার বৈদ্যপুর এক প্রাচীন গ্রাম। মনসামঙ্গল কাব্যে এই গ্রামের নাম পাওয়া যায়।এলাকায় আছে জমিদার বাড়ি। এছাড়া গ্রামটিকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর মন্দির।
বৈদ্যপুরের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থানরাজরাজেশ্বর মন্দির- বৈদ্যপুর জমিদার বাড়ির প্রধান বিষ্ণু বা নারায়ন মন্দির। পূজাবাড়ি থেকে ভেতরে প্রবেশ করলেই বামহাতে একটি দালান মন্দিরে নন্দী পরিবারের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর রয়েছেন। প্রায় ২০০ বছর আগের কথা। নন্দীবংশের জমিদার তখন শিশুরাম নন্দী। তাঁর স্ত্রী এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, একটি নারায়ণ শিলা প্রতিষ্ঠা করলে তাঁদের ব্যবসা ও জমিদারির সমৃদ্ধি হবে। পরদিন সকালে এক সন্ন্যাসী আসেন এবং তাঁর কাছ থেকে তিনি একটি নারায়ণ শিলা লাভ করেন। ইনিই কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর। সমৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোনার সিংহাসনে দেবতা স্থান লাভ করেন। উৎসব ও পূজা বেড়ে যায়। রথ, পঞ্চমদোল আর রাস উৎসবে দেবতা সোনার সিংহাসনে পালকি করে পরিক্রমা করতেন। জমিদারি চলে যাওয়ার পর দেবতাও চুরি হয়ে যায়। আবার নতুন নারায়ণ শিলা প্রতিষ্ঠা হয় যাগযজ্ঞাদির মাধ্যমে। সোনার সিংহাসন ও মূল্যবান জিনিস আর মন্দিরে নেই। রুপোর সিংহাসনে রাজরাজেশ্বরের দর্শন পাওয়া যায় নিত্যপূজার সময়।
নবরত্ন মন্দির- প্রাচীন জোড়া মন্দির। এদের মধ্যে বড়টি নবরত্ন এবং দক্ষিণ পাশেরটি আটচালা রীতির। দুটোই শিবমন্দির। নবরত্ন মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মন্দিরটিতে এখনও কিছু টেরাকোটার কাজ ও তার সঙ্গে ফুলকাটা নকশার কাজ আছে। ১৭২৪ শকাব্দ অর্থাৎ ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে নন্দী বংশের জয়দেব নন্দী মায়ের স্মৃতিরক্ষার্থে এই মন্দির তৈরি করেন। দুটি মন্দিরই পূর্বমুখী এবং দুটিই দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ১০ ফুট করে বর্গাকার। নবরত্ন মন্দিরটির উচ্চতা মোটামুটি ৩৫ ফুট। প্রাচীনত্বের কারণে মন্দিরটির ভগ্নদশা, সম্প্রতি একটি চূড়া ভেঙে পড়েছে। মন্দিরের কারিগর ছিলেন জনৈক শ্রীজগন্নাথ। নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে সাড়ে চারফুট উচ্চতার বিশালাকার শিবলিঙ্গ আছে।
বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির- রাসমঞ্চের কাছে আছে নবরত্ন বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির। মন্দিরের সামনে দালান নাটমন্দির এবং সমগ্র চত্বরটি চকমিলান স্থাপত্য। প্রতিষ্ঠালিপি থেকে জানা যায় যে শিশুরাম নন্দীর তিন পুত্রের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলার ১২৫২ সনে অর্থাৎ ইংরেজির ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। এই গ্রামের মধ্যে দক্ষিণেশ্বরের মতো সুন্দর নবরত্ন মন্দির অবাক করে দেয়। কালো কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ ও অষ্টধাতুর রাধা মূর্তি পূজিত হচ্ছেন। বৃন্দাবনচন্দ্র নন্দী বংশের অন্যতম পূজ্য দেবতা। এই দেবতার জন্য তাঁরা নবরত্ন মন্দির, নাটমন্দির, নহবতখানায় বিশাল প্রবেশদ্বার, ভোগের ঘর, দেবতার শোবার ঘর, রাসমঞ্চ প্রভৃতি তৈরি করেছিলেন।
মন্দিরের প্রধান উৎসব রাস। কাছেই রয়েছে দোলমঞ্চ ও অন্যতম দর্শনীয় বিরাট রাসমঞ্চ। রাসমঞ্চটি বেশ বড় ও সুদৃশ্য কারুকার্য করা। আগে বিরাট মেলা ও কীর্তনের উৎসব চলত। জমিদারির কাল চলে গিয়ে মেলার উজ্জ্বলতাও কমে গেছে।
পূজাবাড়ি- বাড়ির ভেতরে দুর্গা দালান। বৈশাখ থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত এই বাড়িতে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবীর পুজো হয়। তেমনই রাস, ঝুলন, মনসা, ষষ্ঠী প্রভৃতি দেবতার পুজোও হয়। পূজাবাড়ির ভেতরে চারদিকে দালান দিয়ে ঘেরা পূজামণ্ডপ। প্রধান দরজা দিয়ে দু’পাশে বসার জায়গা। বামদিকে একটি প্রাচীন শিবমন্দির রয়েছে। মূল ঠাকুরদালানটি কয়েকটি কারুকার্য করা থাম দ্বারা নির্মিত। দোতলা পূজাবাড়ির ওপর-নীচে অনেকগুলি ঘর আছে। সবই পুজোর কাজে ব্যবহার করা হয়। চারদিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা মাঝের অংশটিতে আগে ভক্তিগানের আসর বসত বা যাত্রার সময় সরগরম থাকত। মহিলারা বারান্দা থেকে চিকের ঘেরাটোপ দিয়ে দেখতেন।
পূজাবাড়ির প্রবেশপথটি আভিজাত্যের চিহ্ন বহন করছে। ফটকের উল্টো দিকে নহবতখানা। প্রবেশপথের বাঁ পাশে আগে একটি টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ শিবমন্দির ছিল। পূজাবাড়ি তৈরির সময় সেটি দোতলা বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়।
পূজাবাড়ি পেরিয়ে রাজভবন, কাছারি বাড়ি, বৈঠকখানা ও একটি পঞ্চরত্ন শিবমন্দির। মন্দিরটির টেরাকোটা ফলকগুলি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। জমিদারবাড়ির বিভিন্ন মহলের মধ্যে আর একটি কাছারিবাড়ি। বৈদ্যপুরের জমিদারদের এক সময়ের কাছারিবাড়ি আজ প্রায় পরিত্যক্ত, জনশূন্য। বিরাট ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে পলেস্তারাহীন ছোটো ইটের ইমারত, উল্টো দিকে উচুঁ সুদৃশ্য বৈঠকখানা।
( হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনের যে কোনো লোকাল ট্রেনে বৈঁচি নেমে, স্টেশন থেকে কালনাগামী যেকোনো বাসে অথবা, হাওড়া কাটোয়াগামী ট্রেনে কালনা নেমে, বৈঁচিগামী বাসে বৈদ্যপুর যাওয়া যায়।)