অর্ধ শতকেরও আগে চাঁদে মানুষের পা পড়েছিল। এতগুলি বছর পেরিয়ে চন্দ্রাভিযানের ইতিহাস-ভূগোল-বিঞ্জানের পাতা ওলটালে দেখা যাচ্ছে চাঁদ আসলে একটা উপলক্ষ মাত্র। মূল লক্ষ্য মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার।

শেষ পর্ব 

চাঁদের মাটিতে পা রাখার অর্ধ শতক পেরি্যে যাওয়ার পরও মহাকাশ দখলের প্রতিযোগিতা  আর ফ্যান্টাসির জগতে নেই।  পুরোমাত্রায় ক্ষমতা প্রদর্শন এবং হুমকি হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাধর দেশগুলি কেবলমাত্র সমস্ত প্রাণ নিশ্চিহ্ন করার জন্যই পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করেনি,  তারা মহাকাশে সামরিকীকরণ করেছে, মহাকাশভিত্তিক সম্পদের ওপর সারা বিশ্বের নির্ভরতাও বাড়িয়ে চলেছে। চাঁদ এখন অনেক দেশের কাছে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য একটি প্রাকৃতিক স্টার্টিং পয়েন্ট। এই অবস্থার ঝুঁকিও প্রচুর। মহাকাশে আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চাঁদে মার্কিন নভোচারীদের অবতরণের বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তেমনভাবে স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মহাকাশ দখলের প্রতিযোগিতাও অন্য মাত্রা দিয়েছিল।

১৯৭৯ সালে চাঁদ ও মহাশূন্যে  বিভিন্ন দেশের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সমঝোতা প্রস্তাব আনে জাতিসংঘ, যেটি ‘ মুন এগ্রিমেন্ট’ নামে পরিচিত। সেখানে মূল বিষয়গুলো ছিল, চাঁদ ও মহাশূন্যে কাজকর্ম চলতেই পারে তববয়ে তা হবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং কোনও মহাকাশ স্টেশন বানাতে হলে আগে জাতিসংঘকে অবশ্যই জানাতে হবে, তাছাড়া কেন এবং কোথায় তারা সেটি বানাতে চায় সেকথাও জানাতে হবে। ওই চুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, চাঁদ এবং মহাশূন্যের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পত্তিতে সকলের সমান অধিকার থাকবে। যখন সেখান থেকে খনি আহরণ সম্ভব হবে, তখন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে, যারা সেই আহরণের বিষয়গুলো দেখভাল করবে।

কিন্তু ওই চুক্তিটির সমস্যা হল, মাত্র ১১টি দেশ সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স ও ভারত। কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন, চিন এবং রাশিয়ার মতো মহাকাশ গবেষণার প্রধান দেশগুলো চুক্তিটি সমর্থন করেনি। চুক্তিতে উল্লেখ করা আইনগুলোর প্রয়োগ করা ততটা সহজ নয়। কারণ এসব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে সেটিকে তাদের আইনে পরিণত করতে হবে এবং কোম্পানি বা ব্যক্তিদের সেটা মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। জার্নাল অফ স্পেস ল’ এর প্রক্তন সম্পাদক জোয়ান্নে ইরিনে গ্রাব্রিনোভিচের মতে, আসলে আন্তর্জাতিক সমঝোতা বাস্তবে কোনও নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ সেটির বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং গণ মতামতের ওপর নির্ভর করে। তাছাড়া মহাশূন্যের গ্রহ-উপগ্রহের ওপর মালিকানা না থাকার বর্তমান চুক্তিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

ভারতের পাশাপাশি জাপান এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলের মতো ছোট ছোট দেশও চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু আমেরিকা তার অবস্থান কী সহজে ছেড়ে দেবে?  না।  প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী পাঁচ বছরে আমেরিকার মহাকাশচারীদের চাঁদে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন, বিশ শতকে যেমন তাঁরা চন্দ্র অভিযান করেছেন ২১ শতকেও  মহাকাশচারীদের চাঁদে পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁরা প্রথম হবেন।

এই মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুধু বড়াই নয়, দেশগুলি আক্ষরিক অর্থেই তাদের সামরিক মহাকাশ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ জন্য ট্রাম্প মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরকে মহাকাশ বাহিনী গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। যেটা হবে একটি স্বাধীন সামরিক শাখা, যার দায়িত্ব হবে মহাকাশ-সংক্রান্ত মিশনগুলো তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করা। আমেরিকা মনে করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এই বাহিনী মহাকাশে আমেরিকার ক্ষমতা একচেটিয়া করতে পারবে। তবে আমেরিকার  প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্যাট্রিক শানাহান পদত্যাগ করার আগে বলেছেন, মহাকাশে আমেরিকার আধিপত্য খুব দ্রুতই শেষ হবে, কেননা নতুন শক্তিগুলি মহাকাশ প্রযুক্তি ও সামরিকীকরণের ক্ষেত্রে সুদক্ষ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শক্তি হচ্ছে রাশিয়া ও চিন।

মহাকাশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই ভারত। নিজস্ব উপগ্রহগুলির একটিকে ধ্বংস করতেও ভারত অ্যান্টি–স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। আমেরিকা,  রাশিয়া ও চীনের পর ভারত চতুর্থ দেশ, যে কিনা মহাকাশে এভাবে নিজস্ব উপগ্রহকে ধ্বংস করল। চিনের ২০০৭ সালের অ্যান্টি–স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র  প্রদর্শনীর মতো ভারতের এই পরীক্ষাও কোনও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েনি। কারণ এটি ছিল মহাকাশযুদ্ধে চিনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলার পেছনে যেমন যুক্তি, তেমনই মহাকাশে ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও রয়েছে যুক্তি। পারমাণবিক শক্তির বাড়ানোর পাশাপাশি দেশগুলি তাদের মহাকাশক্ষমতা বাড়িয়ে যাবে,  যতক্ষণ না তারা নিজেদের ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে। মহাকাশে সব ধরনের শক্তির প্রয়োগকে নিষিদ্ধ করবে তেমন কোনও  আন্তর্জাতিক নিয়ম বা আইনও নেই।  ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস চুক্তির আওতায় মহাকাশভিত্তিক মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার বা অ্যান্টি–স্যাটেলাইট পরীক্ষা নিষিদ্ধ করেনি।

 শেষ…

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version