অর্ধ শতকেরও আগে চাঁদে মানুষের পা পড়েছিল। এতগুলি বছর পেরিয়ে চন্দ্রাভিযানের ইতিহাস-ভূগোল-বিঞ্জানের পাতা ওলটালে দেখা যাচ্ছে চাঁদ আসলে একটা উপলক্ষ মাত্র। মূল লক্ষ্য মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার।

তৃতীয় পর্ব 

মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় একটা সময়ে আমেরিকা বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিল। প্রায় দু’দশক ধরে আমেরিকার নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত হওয়া ভূ-উপগ্রহকে শক্তি জুগিয়েছিল রুশ আরডি-১৮০ ইঞ্জিন। এরপর আমেরিকা যখন মহাকাশে নতুন করে প্রতিযোগিতায় নামার পরিকল্পনা শুরু করে তখন এক ধরণের অসুবিধার সম্মুখীন হয় তারা। রাশিয়ার ওপর দীর্ঘ সময়ের নির্ভরতাই যার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংকট ও ২০১৬ সালে আমেরিকার ভোটে রুশ হস্তক্ষেপ প্রশ্নে আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে সরে এসে রুশ ইঞ্জিনের ওপর থেকে নির্ভরতা পুরোপুরি হটিয়ে নিজেরা কাজ শুরু করে দেয়। আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দেশে তৈরি রকেট উৎক্ষেপণ করবে। আমেরিকা ইতিমধ্যেই তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অন্য দেশের কোনও সরঞ্জাম ব্যবহার না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমেরিকার কাছে এই মুহূর্তে মহাকাশকেই তাদের ‘একিলিস হিল’ বলে মনে হচ্ছে।

আমেরিকার মহাকাশ পরিকল্পনায় যুক্ত হতে চাইছে এলন মাস্কের স্পেসএক্স ও জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন। এ ছাড়া বিশেষ আগ্রহ রয়েছে বড় টেক কোম্পানিগুলিরও। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি এ ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি ডলারের বাজেট করেছে বলে খবর। রাশিয়াও একেবারে বসে নেই। মহাকাশে তারা আমেরিকার চেয়েও দ্রুত গতিতে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। আরডি-১৮০-র মতো দক্ষতাসম্পন্ন ও কম খরচের ইঞ্জিন আছে তাদের, যার কোনও প্রতিযোগী এই মুহূর্তে দুনিয়ায় নেই। মহাকাশ গবেষণাকে প্রতিযোগিতা আখ্যা দেওয়া চলে। গত শতকের ৬-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকার  প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিল স্নায়ুযুদ্ধ। অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রে দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার অংশ ছিল সেটি। আলাদা না হলেও সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে। ফারাকটা হচ্ছে, সে সময় ছিল পুঁজি ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, যা এখন আর নেই বলা যায়। সেই দ্বন্দ্বের পৃথিবীতে এখন রাজ করছে পুঁজি, প্রযুক্তি ছুটছে সময়ের আগে। এই অবস্থায় ‘স্টার ওয়ার’-কে কী শুধু কল্পনা ভাবা যায়?

 মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় অন্য দেশগুলির তুলনায় চিন তুলনামূলক ভাবে নতুন। তবে অরবিটে প্রথম নভোচারী পাঠানোর মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে চিন বিস্ময় ঘটিয়েছে অবশ্যই। সম্প্রতি চিনের স্পেসক্রাফট চাঁদের বহু দূরের জমিতে সফলভাবে ল্যান্ড করেছে। কেবল তাই নয়, আগামী দিনে চিন নতুন একটি মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করার কথা ভাবছে। পাশাপাশি, চাঁদে একটি বেস ক্যাম্প স্থাপন এবং মঙ্গলে অভিযান চালানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে।

আমেরিকার রয়্যাল অ্যারোনোটিকেল সোসাইটির ফেলো অধ্যাপক কেইথ হেওয়ার্ড জানান, আমেরিকা ও রাশিয়া যে উদ্দেশ্যে মহাকাশ গবেষণার কাজ করছে, চিনের লক্ষ্যও একই। চিনের সেনাবাহিনী ঠিক এটাই চেয়েছিল। কারণ এই কর্মসূচীতে যত অর্থ খরচ হয়েছে, তাদের আগ্রহ ছাড়া তার অর্ধেকও পাওয়া সম্ভব হত না। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা ও সামর্থ্য প্রকাশের জন্য এটি একটি দারুণ উপায়। তৃতীয়ত, এখনও খোজ পাওয়া যায়নি এমন এনার্জি বা জ্বালানীর সন্ধান। মূলত এই তিন কারণেই চিন মহাকাশ গবেষণায় এত মনোযোগী এবং এত অর্থ ও  সময় খরচ করছে। তবে চিনের মহাকাশ গবেষণা কিংবা পরিকল্পনা আমেরিকাকে এখনও পর্যন্ত চাপে রেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। 

আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এক বছর আগে ‘ইউএস স্পেস ফোর্স’-এর কথা স্পষ্ট করে জানানোর পর অধ্যাপক কেইথ হেওয়ার্ড জানান, অ্যামেরিকা এখন মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রচুর খরচা করছে। এই খরচ যে কেবলমাত্র নাসার মাধ্যমেই হচ্ছে এমনটা নয়। এই খাতে পেন্টাগন-ও প্রচুর টাকা খরচ করছে। তাই চিনের মহাকাশ অভিযান বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমেরিকার তেমনভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই। বলা যায় এখান থেকেই আসলে মহাকাশে নতুন প্রতিযোগিতার শুরু? কারণ চাঁদে চিনের স্পেসক্রাফট পৌঁছানোর মাত্র ক’দিন আগেই নাসার আরেকটি সফল অভিযানের মাধ্যমে বরফ-ঢাকা এক নয়া দুনিয়ার খবর এসেছিল। যদিও অধ্যাপক হেওয়ার্ড এটাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখতে চাইছেন না। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ইন্টারন্যাশনাল লুনার এক্সপ্লোরেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বার্নাড ফোয়িং বলছেন, যে কোনও ধরণের অগ্রগতিআসলে সমস্ত মানুষের কল্যাণের জন্যই। বার্নাড ফোয়িং আরও বলেন, মহাকাশ গবেষণায় চিন তার অগ্রগতি দেখিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সবার সঙ্গে মিলে-মিশে কাজের আগ্রহ-ও প্রকাশ করেছে। তবে, অন্য সব দেশ চিনের সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করতে পারলেও আমেরিকা পারবে না। কারণ দ্বিপাক্ষিক ভাবে নাসার কারও সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমেরিকা নিষেধ রয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু করতে হলে আমেরিকার কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে।

চলবে…

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version