জামাইকান মেন্টো লোকগানের সঙ্গে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ক্যালিপসোকে জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। লোকগানের পাশাপাশি ব্লুজ, গসপেল এমনকী আমেরিকান  স্ট্যান্ডার্ড-এর মতো জঁরেও তিনি গান গেয়েছিলেন।আবার ‘জাম্প ইন দ্য লাইন, ‘দ্য বানানা বোট সং, ‘ওডস এগেনস্ট টুমরো, ‘কারমেন জোন্স, ‘আইল্যান্ড ইন দ্য সান,  ‘ডে-ও, ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল বা ‘ক্যালিপসো-র মতো অ্যালবাম আমেরিকা ছাড়াও বহু দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। একক শিল্পী হিসাবে ক্যালিপসো অ্যালবামটি ১০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষে শ্বেতাঙ্গ নয় এমন একজন শিল্পী হিসাবে তাঁর আয় ছিল সব থেকে বেশি। তিনি একজনই শিল্পী যিনি নিউ ইয়র্কের বিরাট কনসার্টে ক্যালিপসো বা ব্লুজ গাইছেন, তিনিই আবার ওয়াশিংটনের রাস্তায় মিছিলে স্লোগান দিচ্ছেন। ফলে হোয়াইট হাউস তাঁকে চোখ রাঙাচ্ছে আর তিনি হাসতে হাসতে গিটার বাজিয়ে গান ধরছেন। যে গান ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে মানুষের গান। মানুষের লড়াইয়ের গান, মুক্তির গান। কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী হ্যারি বেলাফন্টে গত শতকের ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত গায়ক, চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেতা যাঁর রোজগার অনেককেই চমকে দিয়েছিল আর তিনি সেই টাকা বিলিয়ে দিতেন মানুষের মুক্তি  আন্দোলনে।

হ্যারি বেলাফন্টে আমেরিকার সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম স্মরণীয় নাম তো অবশ্যই।এছাড়াও আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের আগল ভাঙতে তিনি নিজের গানকে হাতিয়ার করেছিলেন।গত শতকের পাঁচের দশকে আমেরিকান লোকগানের জগতে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন।সাদা-কালো বর্ণভেদ যখন আমেরিকান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন কালো চামড়ার বা শ্বেতাঙ্গ নয় এমন এক গায়কের ব্যারিটোন কন্ঠ শুধুমাত্র আমেরিকাতেই নয়, সারা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি কেবলমাত্র গানের হাত ধরেই বর্ণবৈষম্য পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজের কাছে পৌঁছতে সফল হয়েছিলেন। এমনকী সাম্প্রতিক সময়ে অশক্ত শরীরেও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। অনেকের মতে, ক্যারিবিয়ান-আমেরিকান শিল্পীদের মধ্যে তিনিই সফলতম, তা শুধু রেকর্ডিং স্টুডিয়ো নয়, মঞ্চেও ঝড় তোলেন হ্যারি বেলাফন্টে। একসময় ইচ্ছে ছিল অভিনেতা হওয়ার তাই গানের পাশাপাশি অভিনয় জগতেও পা রেখেছিলেন। গায়ক হিসাবে যখন তিনি  জনপ্রিয়তার শিখরে তখন রূপোলী পর্দার জন্যেও তাঁর কাছে প্রস্তাব আসতে থাকে। এক সময় হলিউডের প্রথম সারির অভিনেতার তালিকাতেও হ্যারি বেলাফন্টের নাম ওঠে।

ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে বেলাফন্টে পড়াশোনা করতে পারেননি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান নৌসেনায় যোগদান করেছিলেন। অভিনেতা হবেন বলেই যুদ্ধ থেকে ফিরে অভিনয়ের ক্লাসে যোগ দেন, সে সময় তার সঙ্গে অভিনয় শিখতেন মারলন ব্রান্ডো, ওয়াল্টার ম্যাথ ও টনি কুটিসের মতো অভিনেতারা। পাশাপাশি চলে গানের চর্চ্চা। নিউইয়র্কে নানা ক্লাবে গান গেয়ে প্রথম জনপ্রিয়তা পান। ওই সময়ে মাইলস ডেভিস, চার্লি পার্কারের মত শিল্পীদের দলে তার জায়গা হয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডের লোকসংগীতে মানুষের হৃদয় তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল।১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম অ্যালবাম। তিনি সংগীতের মাধ্যমে জাতিগত বিভেদ ভেঙে দিয়েছিলেন। ক্রমে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে একটি গতিশীল শক্তি হয়ে উঠেছিলেন। বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা একটা সময় যখন আমেরিকায় ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং কালো চামড়ার মানুষগুলিকে একেবারেই ছোট করে দেখা হত, তখন বিভেদ- বৈষম্য ঘুচিয়ে দিতে গানকেই হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন তিনি। তিনি ক্যারিবিয়ান সংগীতে ‘Day-O’ (দ্য বানানা বোট সং) এবং ‘Jamaica Farewell’-এর মতো হিট গান রেকর্ড করে শ্রোতাদের মনে উন্মাদনা জাগিয়েছিলেন। অ্যালবাম ‘Calypso’-র এই দুটি গান প্রকাশের পরপরই বিলবোর্ড অ্যালবাম চার্টের শীর্ষে পৌঁছেছিল। এলভিস প্রিসলির সাফল্যের ঠিক আগে, এটিই ছিল একক শিল্পীর প্রথম অ্যালবাম, যা এক মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল।

গত শতকের ৬০-এর দশকে আমেরিকার বেশ কিছু নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়েছিল। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মানবাধিকার নিয়ে বেশ কিছু সক্রিয় আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। বেলাফন্টে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো এবং ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজের বামপন্থায় আজীবন বিশ্বাস রেখেছিলেন। বেলাফন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মার্টিন লুথার কিং। তিনি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। বিভিন্ন আন্দোলনে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মার্টিন লুথার কিং-সহ অন্য অধিকার কর্মীদের জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে জামিনের দায়িত্বও নিতেন তিনি। ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেও হৃদ্যতার সম্পর্ক। আফ্রিকায় দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও এইডসের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন তিনি। হয়েছিলেন ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত।একবার ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষের ওপর একটি সংবাদ প্রতিবেদন দেখে বেলাফন্টে আমেরিকার শিল্পীদের একত্রিত করে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদেরে জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে ১৯৮৫ সালে তারকা সংগীত শিল্পীদের নিয়ে ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে এক কনসার্ট আয়োজন করেন। সেই অনুষ্ঠানে মাইকেল জ্যাকসন, স্টিভ ওয়ান্ডার, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, বব ডিলান, রে চার্লসের মত তারকারা একসঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version