সপ্তম পর্ব

সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওই হঠাৎ পাওয়া দিদিকে বুঝিয়ে বললাম,আমি ইয়ুথ হোস্টেলে উঠলে সবদিক থেকেই সুবিধা হবে। ওখানে পেয়ে যাব কল্যাণীর ওই গ্রুপটাকে, সর্বোপরি কমলদা কে।দিদি এবার কারণ দেখালেন, আমি খাবো কি? এখানে বাইরের খাবার আমি খেতে পারবো না,সবই সাউথ ইন্ডিয়ান প্রিপ্রারেশন। এত দুরে সমুদ্র পেরিয়ে এরকম এক দিদি পেয়ে তখন আমার চোখ প্রায় ভিজে গেছে। দিদির অনিচ্ছায়, পারলে প্রতিদিন রাতে আসবো এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি এসে উঠলাম সেলুলার জেলের অদূরে, রস আইল্যান্ডের উল্টো দিকে ইয়ুথ হোস্টেলে। আমাকে ইয়ুথ হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন দিদি ও তাঁর পরিবারের সবাই। মাষ্টার মশাই নিজে তদারকি করে ইয়ুথ হোষ্টেলের কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে হোষ্টেলের ডর্মিটরিতে আমার বিছানা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

ডর্মিটরির হলে সার সার ১২টি বিছানা আর প্রত্যেকের জন্য একটা করে ওয়ার্ডরোব, সেখানে জিনিসপত্র রেখে চাবি লাগিয়ে দেওয়া যায়। কল্যাণীর বন্ধুরা প্রথম দিনেই আমাকে পেয়ে হৈহৈ করে উঠলো। একটু পরেই দেখলাম জাহাজে আমার নিচের ব্যাঙ্কের সেই ধুতি পাঞ্জাবি পরা সৌম্য দর্শন মধ্যবয়সী বাঙালি ভদ্রলোক এখানেও আশ্রয় নিয়েছেন আমার পাশের বিছানায়। কল্যাণীর ৮ জন ও আমি। ওই ভদ্রলোক বাদে আরও একজনের সঙ্গে পরে দেখা হলো ,তিনিও বাঙালি। মোট ১১ জন। ১ টি বেড খালি। সেসময় ডর্মেটরির ভাড়া ছিল জন প্রতি ৪ টাকা। হোষ্টেলের ম্যানেজার কাম কেয়েরটেকার বয়স্ক দক্ষিণ ভারতীয়  খুব ভদ্র একজন মানুষ। হোষ্টেলে ডাইনিং কিচেন সবই রয়েছে তবুও রান্না হয়না রাধুনির অভাবে।  ম্যানেজার ভদ্রলোক নিরামিষাশী, নিজেই রান্না করে খান। আর আমাদের সারাদিনের আহার ইয়ুথ হোষ্টেলের অদূরে বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক হোটেলে। হোটেলের খাবার দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচের হলেও নিরামিষ নয়, মাছ, মাংস, ডিম সবই পাওয়া যায়। সব রান্নাতেই টক আর ঝাল। খানিকটা  অন্ধ্রের খাবারের মতো, তার সঙ্গে বাঙালি মিশ্রণ। একদিন অবশ্য ম্যানেজার ভদ্রলোকের ধার দেওয়া স্টোভে আমরা রান্নার চেষ্টা চালিয়েছিলাম তার রূপ, স্বাদ আর গন্ধের কথা ভাবলে এখনো আমি শিউরে উঠি।

প্রথম দিন হোটেলে খেতে গিয়ে ভীষণ চমকে গেলাম কারণ মুরগী ও খাসির সঙ্গে হরিণের মাংসও পাওয়া যায়। অথচ শুনেছি  হরিণ মারা বারণ। দাম আলাদা করে বেশি নয়, ঠিক মনে নেই সম্ভবত ৫ টাকাতে ডাল, ভাত,সবজি, ছোট দু’চার টুকরো শঙ্কর  মাছের ঝোলের সঙ্গে ৪ পিস হরিণের মাংস। প্রথম দিন আনাস্বাদিত এবং জীবনের প্রথম  হরিণের  মাংস  খেতে গিয়ে একটু অসুবিধা হয়েছিল বটে, কিন্তু শুরু করার পর একদিনও ছাড়ান দিই নি।খুব সকাল সকাল উঠে বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে চা খেয়ে কমলদা আর তাঁর বিএডের সহপাঠীদের সঙ্গে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। আন্দামানের কোথায় কখন কি ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি  সে বর্ননায় যাওয়ার দরকার নেই, সেটা গাইডবুক বা নেট বাবু আমার চেয়ে অনেক ভালো বর্ণনা  করে দেবেন । তবে মনে রাখবেন তখন নেট স্যারের জন্মানোর কথা হয়তো কল্পনাতেও আসেনি। শুধু ‘রস আইল্যান্ডে’র কথা বলি, বলি আর দু’একটা খুচরো ঘটনা।

আজকাল শুনেছি রস আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য নিয়মিত লঞ্চ সার্ভিস হয়েছে। সেসময় রস আইল্যান্ডে যেতে হলে নেভির অনুমতি লাগতো, যেতে হতো নেভির লঞ্চে করে। ছিল বেশ নিয়ম কানুনের ফ্যাকড়া। আজকের মতো সবাই তখনও আন্দামানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েনি তাই যথেষ্ট যাত্রী সংখ্যাও একটা ব্যাপার ছিল। যাই হোক আমরা যাওয়ার অনুমতি যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কল্যাণীর ওই ছাত্রদের সঙ্গে আমি ও আরও কয়েকজন, ‘ভারতীয় নৌসেনা’র লঞ্চে করে রস আইল্যান্ড গিয়েছিলাম। রস আইল্যান্ড তখন প্রায় পরিত্যক্ত, শুধু অজস্র হরিণ, ময়ুর, আর বিশাল বিশাল দানবীক কাঁকড়ার চারণভূমি। নেভির এক ছোট্ট ঘর, কয়েকজন নেভির সেনা ছাড়া আর ছিল ভগ্ন পরিত্যক্ত ব্রিটিশ রাজপুরুষ দের সৌধ, মাটিতে  পড়ে থাকা হাজার হাজার নারকেল। নেভির চোখ এড়িয়ে কোনকিছুই ওখান থেকে নিয়ে আসার অনুমতি ছিল না। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর নেভির লঞ্চই ফিরিয়ে দিত দীপের মূল ভূখন্ডে। আমরা যেদিন রস আইল্যান্ড যাই  সেসময়  যে ক’জন নেভির কর্মী ওখানে ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন এক বাঙালি অফিসার , তিনি আমাদের চায়ে আপ্যায়িত করেছিলেন।

ব্রিটিশ জরিপ কর্মী ‘স্যার ড্যানিয়েল রসে’র নামে নাম করণ হয় এই রস আইল্যান্ডের। ড্যানিয়েল রস এই দীপটিকে চিহ্নিত করে দীপান্তর অর্থাৎ আন্দামানে নিয়ে আসা বন্দীদের পাহার দেওয়া ও ব্রিটিশ শাসিত ‘আন্দামান’ ও ‘নিকোবরের’ হেড কোয়ার্টার হিসাবে। শোনা যায় আন্দামান ও নিকোবর দীপপুঞ্জ খুঁজে পাওয়ার প্রায় ৬০ বছর পর তথাকথিত সভ্য ব্রিটিশ ১৮৫৮ সালে ৭৭৩ জন বন্দী কে নারকীয় ভাবে প্রায় গরু ছাগলের মতো করে নিয়ে আসে ‘জেমস প্যাটারসন’। মাঝ সমুদ্রে কতজনের মৃত্যু হয়েছিল সে হিসেব অবশ্য নেই। এর পরের সপ্তাহেই নাকি কলকাতা থেকে আনা হয় ২০০ জন বন্দী কে যাঁরা মূলত ছিলেন ‘সিপাহী বিদ্রোহ ‘ এবং ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলনের প্রতিবাদী। জেলর প্যাটারসেনর নির্দেশে তাঁদের পাঠানো হয়েছিল রস আইল্যান্ডে। নির্মম অত্যাচারের মধ্যে তাঁদের লাগানো হল বন কেটে বসতি তৈরির কাজে। নিজেদের থাকার ছাউনি থেকে আরম্ভ করে  সাহেবদের বাংলো, তৈরি হতে লাগল অনাহারী বন্দিদের ঘাম আর রক্তে। সেসময়ে তাদের হেড কোয়ার্টার রস আইল্যান্ড কে  মনের মতো করে সাজিয়েছিল ব্রিটিশেরা। বিলাসবহুল বাংলো, বড় গির্জা, বলরুম, বেকারি, সমাধিস্থান থেকে শুরু করে সব কিছুই।

দ্বীপান্তরে থাকা বন্দিদের অধিকাংশেরই  মৃত্যু হত অনাহার, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া এবং পেটের অসুখে। গিনিপিগকের মতো  যে কোনো নতুন ওষুধের পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োগ হতো এই বন্দীদের উপর। তাতেও মারা যেতেন অনেকেই।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে ‘জাপানি’ রা। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ অবধি এই দ্বীপ ছিল জাপানিদের অধিকারে। সে সময় ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরে রস আইল্যান্ডে একদিন নাকি ছিলেন ‘নেতাজি সুভাষচতন্দ্র বসু’। পোর্ট ব্লেয়ারে তিনি জাতীয় পতাকাও নাকি উত্তোলন করেছিলেন। রস আইল্যান্ড এখনো হাজার হাজার অসহায় বন্দীর দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হয়ে হাহাকারের মতো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।

চলবে

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version