ঝড়ে আশ্রয় নেওয়া এক পুরোহিত, এক কাঠুরিয়া এবং এক কমোনার তিন দিন আগে বনের মধ্যে কিভাবে বাঁশের ঝোঁপে একজন সামুরাইয়ের লাশ খুঁজে পাওয়া গেল সেইকথা বলতে বলতে, তাদের নিজেদের প্রেক্ষিতে ঘটনা বলতে থাকে, তখন দেখা যায় প্রত্যেকেই নিজেদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সেই সময় কমোনার বলে, “মিথ্যা বলা মানুষের স্বভাব। বেশিরভাগ সময় আমরা নিজেদের ক্ষেত্রেই সৎ হতে পারি না”। এ কথার পর পুরোহিত বলে, “হতে পারে। তবে এর কারণ হল মানুষ দুর্বল, তাই আমরা মিথ্যা বলি, এমনকি নিজের কাছেও”।

ওদের মধ্যে কে যে সব থেকে সঠিক বা সত্যি কথা বলছে তার কোনো স্পষ্ট আকার ইঙ্গিত নেই। ফলে আমরাও ঠিক ওদের এবং ওদের কথা আলাদা করতে পারি না, যার ফলে আমরা ওদের মধ্যে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না। বরং তার বদলে প্রতিটি সাক্ষ্যকে যখন সমানভাবে ঠিক বা সত্যি বলে মনে হয়, তখন আমরা নিজেরাই আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে কে আসল অপরাধী। আর এই সিদ্ধান্তে আমরা একে অপরের থেকে ভীষণভাবে আলাদা।

এটা বলা যেতে পারে যে অন্তত দুটি নির্দিষ্ট অবস্থার অধীনে এরকমটা ঘটে। প্রথমত, আসলে কী ঘটেছিল তা যাচাই করার কোনো দৃঢ় প্রমাণ নেই, এবং দ্বিতীয়ত, ঘটনাটির একটি রায় প্রদান করার জন্য চাপ থাকে, প্রায়শই একজন কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা তা প্রদান করা হয় যারা নিশ্চিত সত্য সনাক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ওই ঘটনার ধারণাটি একটি একক, যা বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ধারণাকেই দুর্বল করে দেয়।

জাপানি লেখক রিয়োনোসুকে আকুতাগাওয়ারের ছোট গল্প ‘ইন দ্য গ্রোভ’থেকে অনুপ্রাণিত এবং আরও একটি গল্পকে যুক্ত করে ১৯৫০ সালে আকিরা কুরোসাওয়া ‘রাশোমন’ বানিয়েছিলেন। ছবিটিতে কুরোসাওয়ার বলা তিনটি গল্পের মিল হল- ‘একটি দম্পতী জংগলের মধ্যে দিয়ে ভ্রমন করছিল এবং এক দস্যু তাদেরকে অনুসরন করে। মেয়েটি নির্যাতিত হয় ওই দস্যুর হাতে এবং তার স্বামী সেখানে খুন হয়’…। কাঠুরে ও পুরোহিতও ওই তিনটি গল্পই সেখানে উপস্থিত থাকা সেই তিনজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে শুনেছিল। প্রথম গল্পটি বলে দস্যূ, দ্বিতীয় গল্প মেয়েটি এবং তিন নম্বর গল্প ওই মেয়েটির মৃত স্বামীর আত্মার। তিনটি গল্পেই একটি ব্যপার লক্ষ্য করার আছে তা হল, তিনজনই তার নিজের গল্পে বলছে যে খুনটা সে নিজেই করেছে। আবার, তিনটি গল্পেই তারা খুনটি কেন করেছে তার উদ্দেশ্য ও পরিবেশ উল্লেখ করেছে। প্রত্যেকের গল্পেই লক্ষ্য করা যায় যে সে নিজে খুন করেও তার দোষ অস্বীকার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কাঠুরের দাবি- তিনটি গল্পই এক সঙ্গে সত্য হতে পারে না এবং তা অবিশ্বাসযোগ্য। পুরোহিতের দাবি- তিনজনের গল্প এমন নয় যে তা অবিশ্বাস করা যাবে। তারপর কাঠুরে নিজের গল্পটি বলা শুরু করে। নতুন এই গল্পে, সে নিজে তার চোখের সামনে খুনটি হতে দেখে তাতে মনে হতে পারে যে সে যা বলছে তা সত্য। যেহেতু, তার অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ। কিন্তু আসলেই কি তাই?

কুরোসাওয়ার বলা এই গল্প বা কথার মিমাংসাটা আসলে জরুরি ব্যাপার নয়। কারণ‘রাশোমন’-এর প্রতিটি চরিত্রই নিজের দোষগুলিকে কিভাবে ঢেকে রাখে এবং আরেকজনের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়, সেটাই আমরা গোটা ছবি জুড়ে দেখেছি। ছবি দেখতে দেখতে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি মানুষ কখনো নিজেকে আরেকজনের কাছে মুখোস ছাড়া উপস্থাপিত করে না। সে তার নিজের সঙ্গেও প্রতারনা করে। মানুষ যা দেখায় আসলে তা তার আসল রুপ নয়। আর এর ফলে, মানুষ প্রায়ই প্রতারনার স্বীকার হয়। সমাজ থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছে। কিন্তু, বিশ্বাস সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ন একটি অদৃশ্যমান উপাদান। এই ছবির পুরোহিত তার বিশ্বাস প্রবলভাবে ধরে রেখেছিল। যদিও তার সেই বিশ্বাসও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আমরা ছবির শেষে দেখি যে সেই ভেঙ্গে যাওয়া বিশ্বাস ফের গঠন করা হয়েছে।

এমনিতেই কুরোসাওয়ার ছবির মধ্যে আমরা মানব প্রকৃতির হতাশাবাদী দিকগুলির প্রতিফলন দেখেছি। তবে‘রাশোমন’ই তার প্রথম কাজ যেখানে তিনি সেই হতাশাবাদকে সম্পূর্ণ ও সফলভাবে প্রকাশ করেছেন। মানুষের মিথ্যা এবং প্রতারণা প্রবৃত্তির নীরাশাকে কুরোসাওয়া এমন অসাধারণ মাত্রায় নির্মান করেছিলেন যেখানে  চরিত্রগুলোর অহং, দ্বৈততা এবং দম্ভ সত্যকে খুঁজে পাওয়া কঠিন করে তোলে। কার অপরাধের বর্ণনা নির্ভরযোগ্য? কে সঠিক? কেউ বলতে পারে না।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version