যাত্রা শক্তিশালী গণমাধ্যম। নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ি বলেছিলেন, ‘আমাদের জাতীয় নাট্য বলিয়া যদি কিছু থাকে তাহাই যাত্রা।’ নাট্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিয়া হায়দার বলেন, ‘যাত্রাই হতে পারে আমাদের জাতীয় নাট্য।’ তবে দুঃখজনক যে, এ সম্ভাবনা আদৌ আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো না। রাষ্ট্র বরাবরই এই মাধ্যমটিকে ভয় পেত। তাই আইন করে সরকারিভাবে যাত্রার যাত্রাপথ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। অথচ যাত্রা বা যাত্রাগান যুগে যুগে মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। যাত্রার আসরে শোনা যেত বীর পুরুষদের কাহিনি, রাজা-বাদশাহর যুদ্ধের গল্প। লেখাপড়া না-জানা মানুষ যাত্রাগান শুনে দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হত।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সাড়ে তিন দশক পর ইংরেজ-শাসিত বঙ্গদেশে বাংলা নাট্যাভিনয়ের সূচনা করেন রুশ নাগরিক হেরাসিম লেবেডেফ। সে সময়ে গ্রামে-গঞ্জে রাত-ভোর করে বসতো যাত্রাগানের আসর। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে যাত্রা পালায় কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন কৃষ্ণকমল গোস্বামী। ঢাকা শহরে কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রথম যাত্রাপালা “স্বপ্নবিলাস”, ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘বিচিত্রবিলাস’ লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন। খুব সুনামের সঙ্গে তাঁর এই পালা-গান প্রচার হয়েছিল। ১৮৬০-১৮৭৮ এর মধ্যে তার পালা বইয়ের আকারে প্রকাশ পায় এবং ঢাকাতেই প্রথম মঞ্চস্থ হয়। কৃষ্ণকমলের আগে আর কারও যাত্রা-পালা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়নি। এই তিনটি যাত্রা-পালা নিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছিলেন নিশীকান্তচট্টপাধ্যায়। আরও উল্লেখ করতে হয়– যাত্রা বিষয়ে গবেষণা করে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে তিনিই প্রথম ডক্টরেট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

গবেষক নিশিকান্ত চট্টপাধ্যায়ের বই থেকে জানা যায়, কৃষ্ণকমল প্রচলিত কৃষ্ণযাত্রার অসারতা এবং গড্ডালিকা মেনে নিতে পারেননি। তাঁর রচিত নিমাই সন্ন্যাস, স্বপ্নবিলাস, দিব্যোন্নাদ/রাইউন্মাদিনী (১৮৪২), বিচিত্র বিলাস (১৮৫০)। এ ছাড়া কালীয়দমন, ভরতমিলন, গন্ধর্বমিলন পালা পর্যালোচনায় তা-ই প্রমাণিত হয়। নিশিকান্তেরআরও একটি তথ্য হচ্ছে, কৃষ্ণকমলের স্বপ্নবিলাস পালার প্রথম অভিনয় ঢাকার বিক্রমপুরে। বিক্রমপুরের আবদুল্লাহপুর গ্রামে অভিনীত হয় দিব্যোন্মাদ পালা। তথ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য, এই আবদুল্লাহপুরের কয়েকজন গুণী শিল্পী পরবর্তী পর্যায়ে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান খালপাড়ে ‘রূপবান’ যাত্রাদল তৈরি করেন, যা খালপাড়ের দল নামে পরিচিত ছিল। যাত্রাপালার আর্শাদ আলী ছিলেন দলের ‘রূপবান’ চরিত্রাভিনেতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রূপবান আর্শাদ নামে পরিচিত ছিলেন। এ দেশের বহু প্রবীণ যাত্রাশিল্পী বলে থাকেন, কৃষ্ণকমল গোস্বামী যাত্রা না লিখলে যেমন গীতিনাট্য চর্চার সূচনা হতো না, তেমনি নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় যাত্রা-সম্পর্কীয় গবেষণা না করলে যাত্রা বিষয়ে পরবর্তী গবেষকদের আমরা পেতাম না।

ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কৃষ্ণকমল গোস্বামীকে ‘বৈষ্ণব পনরুত্থানকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ পালাকার আখ্যা দেন। কৃষ্ণকমলের সুমধুর কন্ঠে শ্রীমদ্ভগবত কথকতা শুনে, সেই- সময়ে পূর্ববঙ্গের মানুষেরা আবেগের বন্যায় ভেসে যেত।  হাজার হাজার মানুষ  ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়তো । সে সময়ে  তাঁর রচিত “নিমাই সন্ন্যাস” যাত্রা-পালা অভিনীত হয়। তিনি নিজে নিমাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেনন। তাঁর অভিনয় দেখে ও পালা গান শুনে দর্শকরা আবেগে চোখের জলে ভাসতো। পূৰ্ববঙ্গে তিনিবড় গোঁসাই নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।

কৃষ্ণকমল গোস্বামী ঢাকায় নাম যশ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর অনেক শিষ্য ছিল;  তাঁর অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞান, ভক্তির উচ্ছ্বাস, সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেখে তাঁকে  সেখানকার মানুষ দেবতার আসনে বসিয়েছিল। তখনকার সময়ে জাতিতে বৈদ্য থাকা সত্বেও তিনি সব জায়গায় ব্রাহ্মণের মতো আদর ও সম্মান পেয়েছিলেন। তখনকার সময়ে পূর্ব-বঙ্গের প্রসিদ্ধ জমিদার ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পিতার মতো  দেখতেন,  বাবা বলে ডাকতেন। তা দেখে একসময়ে একজন ব্যক্তি বৈদ্যেকে এতটা সম্মান দেখানোর জন্য ঈশানচন্দ্রকে শ্লেষের সঙ্গে সে কথা বলতে, ঈশানচন্দ্র  তার উত্তরে বলেছিলেন, “আমার বাবা মানুষ নহেন দেবতা।” এমনকি এক ব্রাহ্মণ জোর করে  তার উচ্ছিষ্ট কৃষ্ণকমলকে খাওয়াতে ব্রাহ্মণমণ্ডলী বিরক্ত হয়েছিলেন।

কৃষ্ণকমলের‘স্বপ্নবিলাস’-যাত্রা (১৮৭২) প্রথম প্রকাশিত যাত্রা গ্রন্থ। এটি কৃষ্ণকমল রচনা করেছিলেন ১৮৬০ সালে। এই যাত্রা পালাটি মুড়াপাড়ার জমিদার এবং ঢাকার আব্দুল্লাহপুর ও একরামপুরের সুধীসমাজ অভিনয়ের আয়োজন করেছিলেন। যাত্রাপালাটি বইয়ের আকারে প্রকাশ হওয়ার পর ২০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল, যা একটি অবাক করা ঘটনা। একই বছর তিনি ‘দিব্যোন্মাদ-যাত্রা’ পালাও রচনা করেন। এ দুটি পালার মাধ্যমে কৃষ্ণকমল গোস্বামী যাত্রাক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টি করেন। তাই ১৮৬০ সালকে যাত্রার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বছর হিসেবে গণ্য করা যায়।

যাত্রার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যাত্রা গবেষক ও কবি ড. তপন কুমার বাগচী লিখেছেন,  ‘১৮৬০ সালে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী কৃষ্ণ বিষয়ক ঢপ কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার যে গতি সঞ্চার করেন, চারণকবি মুকুন্দ দাসের (১৮৮৭-১৯৩৪) হাতে তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জাগরণী মন্ত্র’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version