শেষ পর্ব
লেখার শিরোনাম রেখেছিলাম ‘ফরোয়ার্ড ব্লকের সিংহ ও আন্দামান’। নিছক মজা করে হলেও তার প্রাসঙ্গিকতা ছিল। পরের পর্বগুলোতে শিরোনামের প্রাসঙ্গিকতা হারালেও তাইই রেখেছি। যদিও নামকরণের বদল দরকার ছিল। এক বন্ধু সে পরামর্শ দিয়েছেন, এক্কেবারে শেষ পর্ব তাই বদল করিনি, তাঁকে ধন্যবাদ। আর একটা কথা কৈফিয়ত হিসাবে জানাই, জাহাজে যে খাওয়ার মূল্য তালিকা আমি দিয়েছি তা এক্কেবারে সঠিক নাও হতে পারে। কিছুটা আন্দাজ এবং আজকের বাজারদর অনুযায়ী সেটা কমাতে কিছুটা ভয় কাজ করেছিল। এটাও আমার স্মরণে এনে দিয়েছিলেন বাস্তববাদী সুলেখক এক প্রিয় বন্ধু। কৃতজ্ঞতা তাঁরও কাছে।
এবার ফিরে আসি গল্পে।
আমাদের জাহাজ আন্দামানে নোংর করেছিল কালি পুজার ঠিক দিন তিনেক আগে। ছিলাম তিন সপ্তাহ। ওই একুশ দিনে আমরা সবাই পরিচিত হয়ে পড়েছিলাম শহরের প্রায় সব বাঙালির সঙ্গে । সেটার একটা মজার গল্প রয়েছে।
আমাদের ডর্মেটরির ১১ নম্বর বাসিন্দা টিকে প্রায় দেখাই যেত না। সুস্বাস্থ্যের এই অসম্ভব রূপবান মানুষটি যে কি করেন আমরা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। নামটা আজ আর মনে নেই তবে ওনার বাড়ি নাকি বউবাজারের কাছে বলেছিলেন এটা মনে রয়েছে। এই রহস্যময় মানুষটি নাকি কলকাতা থেকে আসা প্রায় প্রতিটি জাহাজের প্যাসেঞ্জার। কীসব ব্যাবসা ট্যাবসা করেন। ব্যাবসাটি যে বিশেষ সুবিধার নয় সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। বেশি কৌতুহল আমরাও দেখাইনি। তবে মানুষটি আমার অশেষ উপকার করেছিলেন সে গল্প শেষ পাতে।
জাহাজে আমার নিকট পড়শী যিনি ইউথ হোষ্টেলেও আমার পাশের শয্যা টির দখল নিয়েছিলেন সেই ধুতি পাঞ্জাবী পরা সৌম্যদর্শন মানুষটিও ছিলেন বেশ রহস্যজনক। ইনিও নাকি প্রায়শই আন্দামান যাতায়াত করেন। কিন্তু কি কারণে সেটি খোলসা করেননি। সম্ভবত এঁর কাজ কারবারও সুবিধাজনক নয়। আগের মানুষটির কাছে অশেষ উপকার পেলেও এই মানুষটির কাছে হতে হয়েছিল চরম হেনস্থার শিকার। এমন কি অপমানে আমাকে কাঁদতেও হয়েছিল। কল্যাণীর ওই ছাত্রেরা বিশেষত কমলদা রুখে না দাঁড়ালে আমাকে আরও অনেক লাঞ্ছনা সইতে হতো। তখন বয়স ছিল কম, অভিমান ছিল অনেক বেশি, বস্তুত আমি ছিলাম ইউথ হস্টেলের ওই দলটির মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। আর একটু বেশি বয়সী হলে কি করে উঠতাম জানিনা।
ঘটনা হল আমার পাশের ওই মানুষটির কিছু টাকা নাকি হারিয়ে যায় কিন্তু লোকটি সন্দেহ করে সেই টাকা আমি চুরি করেছি। আমার কান্না দেখে কমলদা লোকটিকে মারতে শুধু বাকি রেখেছিল, এমনকি বউবাজারের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেওয়া রহস্যময় মানুষটিও রীতিমত শাসিয়ে ছিলেন ওকে। তখনই জানিয়েছিলেন ওঁর জীবীকা আসলে কি। খুব যে চমকে ছিলাম এমনটা নয়। মনে মনে ভেবেছিলাম এমনটাই হবে।
দেখতে দেখতে আন্দামানে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। কল্যাণীর ওই বিএড গ্রুপের সঙ্গে ঘুরছি ফিরছি বটে কিন্তু ভেতর থেকে এক চাপা আতঙ্ক গ্রাস করে রয়েছে আমাকে। কারণ কলকাতা ফিরে যাওয়ার জাহাজের টিকিট নেই আমার হাতে। প্লেনে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না তখন। আমাকে শ’খানেক বার বিক্রি করলেও প্লেনের ভাড়া উঠে আসতো না। কালি পুজার পরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সময় আন্দামানে যাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন হোমরা চোমরারাও ছিলেন। তাঁরা প্রায় সবাই আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু সে আশ্বাস আমাকে ভরসা যোগাতে পারেনি। কল্যণীর ছাত্রদের ফেরার টিকিট কাটা ছিল, তাই তারা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়িয়েছে আমাকে ভরসা জুগিয়েছে কিন্তু আমার আতঙ্ক কাটেনি। শেষ পর্যন্ত আমি কিন্তু টিকিট যোগাড় করতে সফল হইনি।
সব শুনে এখানে পরিচয় হওয়া আন্দামানের দিদি পরামর্শ দিলেন, চিন্তার কি আছে পরের জাহাজে গেলেই হবে। পরের জাহাজ কবে তার নির্দিষ্ট কোন তারিখ নেই। সেটা একমাস বা তার বেশিও হতে পারে। যতই ভালোবাসা পাইনা কেন, কার্যত যা অসম্ভব।
আমার পরিনতি কি হবে তা নিয়ে কমলদা ও তার কল্যাণীর সহপাঠী রাও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। আমাদের দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখে, সব শুনে বউবাজারের ওই রহস্যময় মানুষটি সজোরে আমার পিঠ চাপড়ে আশ্বাস দিলেন। জানালেন এটা কোন ব্যাপার নয়। আমাকে কলকাতা ফিরিয়ে দেওয়ার দ্বায়িত্ব তাঁর। এও জানালেন, প্রায় প্রতি জাহাজে যাতায়াত করা কি সবসময় টিকিট কেটে সম্ভব? আমার নাকি আরও সুবিধা, কারণ এবারে কলকাতা ফেরার জাহাজের নাম, ‘এম ভি আন্দামান’। অনেক পুরনো এক লজঝড়ে জাহাজ, যার ডেক ক্লাসে কোন সিট নাম্বার নেই, রেলের নন রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টের মতো সিট দখল করলেই হবে। মাঝে টিকিট চেক হয়না এমন নয়, ধরা পড়লে বড়জোর ফাইন হবে। জাহাজ থেকে মাঝ সমুদ্রে তো আর নামিয়ে দেবে না? কল্যানীর ছাত্রদের জানালেন তোমরা আগেভাগে গিয়ে একটা সিট রেখো, আর বাদবাকি দায়িত্ব আমার। আবার আমার পিঠে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে বললেন, তোমাকে ধরাও পড়তে হবে না আর ফাইনও দিতে হবে না। সেটা আমি বুঝে নেব। বুক থেকে জেন একটা ভারি পাথর নেমে গেল, তবুও এক্কেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। এখন ভয় জাহাজে ওঠার সময় না ধরা পড়ে যাই। তারও দাওয়াই দিয়ে দিলেন ওই রহস্যময় মানুষটি।
জাহাজ ছাড়ার নির্দিষ্ট দিনে, ওঁর পরিকল্পনা মতো একটা বাইরে থেকে দৃশ্যমান নেটের ঝোলাতে কলা, পাঁউরুটি, বিস্কুট ভরে দুরুদুরু বুকে ভদ্রলোকের পিছু পিছু নির্বিঘ্নে জাহাজে উঠে গেলাম। ভাবটা এমন, যেন খাবার কিনতে আবার নেমে ছিলাম। ডেকেই অপেক্ষা করছিল কমলদা। ওর সঙ্গে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে এক্কেবারে জাহাজের খোলে, আমার জন্য ওদের রেখে দেওয়া সিটে। জাহাজ ছাড়ার আগে আর উপরের ডেক মুখো হইনি। মাথায় গেঁথে রয়েছে ভদ্রলোকের ওই কথাটা, ‘বিনা টিকিটে ধরা পড়লে মাঝ সমুদ্রে তো আর নামিয়ে দেবে না’, জাহাজ ছেড়ে দিলে আমাকে আর পায় কে? তখন ধরা পড়তেও আমার আপত্তি নেই, বুক বাজিয়ে ফাইন দিয়ে দেব।
শেষ পর্যন্ত ধরা আমি পড়িনি, ফাইনও আমাকে দিতে হয়নি। নির্বিবাদে খিদিরপুর তিন নম্বর ডকে নেমেছিলাম।এবার বুঝতে পারলাম আন্দামান যাওয়ার সময় এম ভি হর্ষবর্ধনের ডেকে যারা কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল তারা করা। প্রতি জাহাজে প্রতি বার কিছুজন থাকে যাদের টিকিট থাকেনা। হয়তো অনেকেরই পয়সা থাকেনা টিকিট কাটার। আবার অনেকেই কাউকে উৎকোচ দিয়ে একটা সমান্তরাল যাতায়াতের ব্যবস্থা করে নেয়।
জাহাজে আগেই কথা হয়েছিল কলকাতায় নেমে আমি সবাইকে খাওয়াবো। কল্যানীর ওই আটজনকে পেয়েছিলাম, কিন্তু আমার পরম উপকারী ওই রহস্যময় মানুষটি কে পাইনি। তিনি আমার প্রস্তাবে আগে রাজি হলেও, জাহাজ থেকে নেমে মুহূর্তে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।
আজ এত বছর বাদে পুরানো স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারে বারে ওই রহস্যময় মানুষ টির কথা মনে পড়ে। হয়তো বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁকে যে কাজটি করতে হয়, সমাজের মূল ধারার কাজের সঙ্গে তার সঙ্গতি নেই, হয়তো তিনি সত্যিই অপরাধী। আমি কিন্তু তাঁকে আজীবন মনে রাখবো।
এরপর কারও সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হয়নি। শুধু কৃষ্ণনগরের কমল দার সঙ্গে কিছু চিঠির আদান প্রদান ছিল। একসময় তাও বন্ধ হয়ে যায়।
আজ অধিকাংশেরই হাতেহাতে মোবাইল ফেরে। কল্যাণীর ওই আট ছাত্র কিংবা নাম না জানা ওই রহস্যময় মানুষ টির নজরে যদি এ লেখা আসে, তারপর যদি আবারও যোগাযোগ হয় তবে তা হবে আমার জীবনের এক পরম পাওয়া। সে আশাতেই রইলাম।