গত বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শিকাগোর অপরাধ জগত হঠাৎ করে বেশ সরগরম হয়ে ওঠে। পুলিশের ব্যর্থতার কারণেই ওই সময় শিকাগোর নানা জায়গায় বেশ কয়েকটি মাফিয়া দল তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। যদিও তারা একে অপরের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতোনা কিন্তু সেবার আচমকাই জর্জ মরানের সন্ত্রাসীরা শিকাগোর টপ মাফিয়া ডন টরিওকে আক্রমণ করে বসলো। সেই আক্রমণ যত না ভয়ঙ্কর,তার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা হল, সন্ত্রাসীরা টরিওকে শেষ করে দিতে পারেনি। ফলে মাফিয়া দলগুলির মধ্যে যে সংঘর্ষ মোটেও ছিল না তা শুরু হয়ে গেল। ফলে শিকাগোর পথে ঘাটে বছর ভর দিবারাত্র শঙ্কা আর চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকলো। এরকম অবস্থায় সব উত্তেজনায় জল ঢেলে দিলেন টপ মাফিয়া ডন টরিও নিজেই। ভয়ে হোক কিংবা অন্য যে কোনো কারণে তিনি একদিন শিকাগো ছেড়ে ইতালি পালিয়ে গেলেন। তার আগে শিকাগোর অপরাধ মসনদে বসিয়ে গেলেন ২৬ বছর বয়সী এক ছোকরাকে।

টরিও পালিয়ে যাওয়াতে শিকাগোর অপরাধ জগত যত না অবাক হল তার থেকে অনেক বেশি ভ্রু কোঁচকালো টরিওর জায়গায় ওই ছোকরার কথা ভেবে। নামমাত্র কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ছাড়া ওই ছোকরার বায়োডেটায় এমন কিছুই নেই যাতে তাঁকে ওই আসনে ভাবা যায়। অনেকেই তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো। তার উপর পাতি মাস্তানদের মতো তার ডান গালে রয়েছে কাটাদাগ। অনেকেই টরিওর নাম ধরে ঠাট্টা করতে থাকলো। টরিও গ্যাং-এর স্ট্যাটাস নিয়েও ব্যাঙ্গও করতে ছাড়লো না। কিন্তু একদিন সেই ছোকড়া তাঁকে নিয়ে সমস্ত ঠাট্টা ব্যাঙ্গের উত্তর দিয়েছিলেন। ধীরে হলেও একদিন সেই ছোকড়া অপরাধ দুনিয়ার মাথায় বসে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলেন। কেবল ক্ষমতা নয়, তিনি তাঁর অপরাধকে এতটাই সুচতুর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে বাঘা বাঘা ফেডারেল এজেন্টরাও কর ফাঁকি ছাড়া তাঁর অন্য কোনো অপরাধের প্রমাণ যোগাড় করতে পারেনি। যে কারণে আলফোনসো কাপোন মাফিয়া সংস্কৃতির এক প্রবাদ পুরুষ বনে গিয়েছিলেন।

আলফোনসো কাপোন জন্মেছিলেন নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে। তার বাবা-মা ইতালি থেকে আটলান্টিকের এপাড়ে চলে এসেছিলেন আরও সুখ সাচ্ছন্দের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। কাপোনের বাবার সাধারণ মানের একটি স্যালোন ছিল। সেখানে রোজগারও বেশি ছিল না। তার মা ঘরে বসে দর্জির কাজ করতেন। খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে দিন গুজরান হত পরিবারটির। এরকম একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা কাপোন ছোট থেকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্কুলের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতেন। সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছে, এই ছেলে বড় হয়ে কিছু একটা হবে, তখনই সে স্কুলের এক শিক্ষককে মারধোর করে বসলেন। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন এমন একটি অপরাধ করার কারণে তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়। সেখানেই শেষ হয় তাঁর লেখাপড়া। এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তিনি মাস্তানি করে বেড়াতেন। স্কুলে হকি খেলার সুবাধে লাঠি চালাতে শিখেছিলেন। তাঁর দাদাগিরি আর মাস্তানি বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের নজর কাড়ে। এরপরই সাউথ ব্রুকলিন রিপারস আর ফোরটি থিভস জুনিয়র নামক দুটি গ্যাংয়ে ভিড়ে যান তিনি। যাদের কারণে ব্রুকলিনের সাধারণ মানুষের রাস্তায় বেড়িয়ে শান্তিতে শান্তিতে চলাফেরা করার উপায় ছিল না। যেকোনো মুহূর্তে ওদের খপ্পরে পড়ে শান্ত নিরীহ মানুষকে সর্বস্ব হারাতে হতো।

ইস্কুলের দিন গুলিতেই জনি টরিওর সঙ্গে আল কাপোনের আলাপ পরিচয়। জনি টরিও তখন নিউ ইয়র্কে জুয়া খেলার ব্যবসা করতেন, থাকতেন আল কাপোনের পাড়ায়। টরিও আল কাপোনকে দিয়ে মাঝে মধ্যেই টুকটাক কাজ করিয়ে নিতেন। কিন্তু টরিও জুয়া ব্যবসায় পয়সার মুখ দেখতেই নিউ ইয়র্কের পাট চুকিয়ে শিকাগো পাড়ি জমান। ইতিমধ্যে স্কুলের মেধাবী ছাত্র থেকে আল কাপোন মাস্তান হয়ে উঠেছেন। টরিওর সঙ্গে ফের আল কাপোনের দেখা হয় কনি দ্বীপে। সেখানে টরিওর সুপারিশেই মাফিয়া বস ফ্র্যাঙ্কি ইয়েল তার বিখ্যাত হার্ভার্ড ইনে আল কাপোনকে মদ পরিবেশকের চাকরিতে বহাল করেন। চলছিল বেশ ভালই, রোজগারও জমে উঠেছিলো। কিন্তু একদিন ঘটে গেল অপ্রীতিকর এক ঘটনা। সুরিখানায় মদ পরিবেশন করার সময় আল কাপোনে এক মেয়ের দিকে অশ্লীল মন্তব্য করায় বেধে গেল গণ্ডগোল। মেয়েটির ভাই নেশার ঘোরে আল কাপোনকে আক্রমণ করতেই শুরু হয়ে যায় ধ্বস্তাধস্তি। ধারালো ছুরি দিয়ে সে কাপোনেকে আঘাত করে। ছুরির আঘাতে আল কাপোনের গাল জখম হয়। চিরদিনের জন্য আল কাপোনের গালে লম্বা কালো দাগ বসে যায়। মদ পরিবেশক আল কাপোনকে তখন থেকে সবাই ‘গালকাটা’ বা ‘স্কারফেস’ নামে ডাকতে থাকে।
চলবে…