একা নয়। দ্যোতনা বোঝাতেই বললাম কথাটা। সাত সকালেই বেরিয়ে পড়লাম মায়ের নাম নিয়ে। এবার লক্ষ্য বাঁকাদহ-বৈতল। গ্ৰীষ্মের প্রখরতা সকাল থেকেই। শুকিয়ে কাঠ সবুজ চাদরে মোড়া মাঠ ঘাট।পথ ঘাট কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা।বিষ্ণুপুর থেকে মেদিনীপুর -হুগলি রাস্তা ধরে চলেছি বাইকে। উঠবো বাঁকাদহ হয়ে বৈতল মোড়ে। তার আগে খানিকটা জিরিয়ে নিলাম চৌবেটার মোড়ে। ফোন করে জানিয়ে দিলাম আদিত্য ও ধনন্জয়দাকে। কতদিনের সম্পর্ক আমাদের। কৃষি অধ্যূষিত এলাকার প্রান্তিক মানুষ ওরা। মাটি মাখা মানুষ। মাটিই তাদের মা।
কতদিন কত রাত কেটে গেছে এই এলাকার মানুষের ভালোবাসায়। আদরে আপ্যায়নে ভরিয়ে দিয়েছে এই চাষাভুসো মানুষগুলো। এঁরাই আমাদের নররূপী নারায়ণ। এখানে নিয়মিত আসতাম। তখন ছিল যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ। বাঁকাদহ আর বৈতল মোড় ছিল সবার কাছেই-ট্রানজিট পয়েন্ট। এখান থেকেই যুদ্ধ অপারেট হতো। আবার স্ট্র্যাটেজিক জোন হিসেবে প্রশাসন ও ক্রিমিন্যালদের কাছে হয়ে উঠেছিল মাথাব্যাথা বা আতঙ্কের কারণ। একটুখানি দক্ষিণ পূর্বে এগোলেই মিলবে মাগুরিয়া,বড় ও ছোট আঙ্গারিয়া,ধাদিকা,চমকাইতলা সহ নানান গ্ৰাম জনপদ।
প্রকৃত অর্থেই সবুজের দেশ। শস্য শ্যামলা প্রান্তর। মাঠেই কাটে দিন রাত। বুলবুলি তে ধান খায় না। ধান আর শাকসবজি ও ফসলের বারোটা বাজিয়ে চলে দলমার দাঁতাল বাহিনী সেদিনের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা জানে না এই প্রজন্ম।আমাদের আলাপচারিতায় তারাও সাগ্ৰহে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। কথা চলতে চলতেই দোকানের ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। এখানকার জনপ্রিয় সাদা বোঁদে দিয়ে গেল শালপাতার ঠোঙায়। শ্রীশ্রী ঠাকুরের অতিপ্রিয় ছিল এই বোঁদে। গাছের ছায়ায় বসে আছি আমরা ক’জন। এরই মধ্যে যেন আগুনের হলকা মাখা গরম বাতাস ছুঁয়ে যায় আমাদের। অগত্যা সংক্ষিপ্তসার করেই গা ঝাড়া দিলাম বৈতলের উদ্দেশ্যে। আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু বৈতল মোড়ে হাজির। তাদের বাড়িতেই হবে মধ্যাহ্ন ভোজন। এই পর্বের বিরতি হবে এখানেই।
এককথায় বলতে পারি এই গুরুত্বপূর্ণ ভূখন্ডটি মল্লভূমের গেটওয়ে। যদিও মল্লরাজত্বের দখলদারি ছিল মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। যুদ্ধ-সংঘর্ষ আবার সেনা অভিযানে মেতে উঠতো এই অঞ্চল। সেকালের বহু বর্ণময় ইতিহাস পড়ে আছে অনাদরে অবহেলায়। আমরা এসেছি মল্লরাজদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির দেউল ও দেবদেবীর বিগ্ৰহ দর্শনে। পুরাতত্ত্বের অন্যতম পীঠস্থানও এই পরিমন্ডল। ঝগড়ভঞ্জনী চন্ডী,শ্যামচাঁদ মন্দির-সহ গড় দুর্গের ইতিহাসও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাকড়া পাথরের ভূমিতলে। কথা বলতে বলতেই আমাদের দিকে এগিয়ে এলো বড় কাঁচের গ্লাস ভর্তি শরবত। এখানেও ভিঁড় জমে গেল। সবাই মিলে উঠে পড়লাম মায়ের মন্দিরের চত্বরে। মন্দিরের গা ঘেঁষে থাকা ছোট্ট চালা ঘরে চলছে ভোগ রান্নার কাজ। পুরোহিত পরিবারের সঙ্গে চললো প্রাথমিক পর্বের আলোচনা।
দাবদাহের জেরে ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে মন্দির মোড়ের বাজার। ফাঁকা হয়ে গেছে বাসস্ট্যান্ড। আইসক্রিমের বাক্স কাঁধে ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি ভিঁড় দেখে সমান কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে এলো।স্কুলের টিফিনের জন্য উদগ্ৰিব হয়ে আছে সে।ইশারা করতেই ডানহাতে থাকা ডুগডুগিটা বাজিয়ে দিল।ছন্দপতন হলো মন্দিরের আড্ডায়। মন্দির থেকেই দেখা যায় একটি কুমোর বাড়ি।চাকা ঘর ঢাকা দেওয়া।হাঁড়ি কুড়ি , খোলা,ঘট মায় মনসার চালি রাখা আছে স্তূপীকৃত ভাবে। টেরাকোটা স্থাপত্যেরও একটু তফাৎ ধরা পড়ে গেল আমাদের নজরে। যদিও বিবর্তন ধরা পড়ে পাঁচমুড়া ,সোনামুখীতেও।
রাস্তা থেকে দেখা যায় কিছু কিছু মানুষজন মাঠের কাজে ব্যাস্ত। মাঠে মাঠে আলু তোলার ধুম।ট্রাকটরে খুঁড়ছে আলু। সঙ্গে সঙ্গে বস্তা বোঝাই হয়ে যাচ্ছে মাঠেই। তারপর হয় বাজার নয়তো হিমঘরমুখী সারি সারি আলু বোঝাই গাড়ি।ফাঁকা মাঠ গুলোতে বসছে বরো ধানের বীজতলা বসানোর কাজ।একটু দূরে ডাঁই করে রাখা হচ্ছে ঝিঙে,করলা,লাউ,কুমড়ো,পটল।সন্ধ্যে থেকে গাড়ি বোঝাই হয়ে পৌঁছে যাবে দূরের বাজারে।এমনকি প্রতিবেশী ঝাড়খন্ড,ওড়িশা হয়ে চলে যাবে দক্ষিণের দেশে। এরই মাঝে আদিত্যদা আমাদের জন্য আনালো দু’হাঁড়ি তাল রস। গেঁজিয়ে ফেনায় ভরে গেছে হাঁড়ির মুখ।গন্ধে বোঝাই যাচ্ছে রস থেকে তাড়িতে রূপান্তরের জারণ ক্রিয়া। বাবা মহেশ্বরকে ডেকে তাঁর ও সঙ্গী সাথীদের উদ্দেশ্যে সামান্য একটু সম্প্রদান করে দাও গলায় ঢেলে। ব্যাস্,গরম আর কোথায় লাগে!
আমরা ব্যাগপত্র সহ সমস্ত জিনিস রেখে চললাম মাঠের দিকে।শশা,লাউ, কুমড়ো,ঝিঙের মাঠে চলছে শ্যালো।ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা ঠান্ডা জলে স্নান করার মধ্যে আলাদা আমেজ,আলাদা তৃপ্তি জাগায় দেহে মনে।ফিরে এসে শ্রীশ্রী মা ঝগড় ভঞ্জনী দেবীর উদ্দেশ্যে প্রনাম জানিয়ে সোজা চললাম বন্ধুর বাড়ির বৈঠকখানায়। মধ্য দুপুরের গনগনে আঁচ ঝলসে দিচ্ছে মাথা আর চোখ মুখ।এখন গোটা দুপুর থেকে পড়ন্ত বিকেল জুড়ে আত্মগোপনের পালা।