দ্বিতীয়পর্ব

বছর পাঁচেক আগের কথা৷ শিক্ষক দিবসে এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের একটা বক্তব্য নিয়ে একটি চ্যানেলে দিনভর বিতর্ক চলেছিল৷ দিন শেষে টক শোতে আলোচনার নির্যাস হিসাবে উঠে এসেছিল শিক্ষক হওয়ার দুঃখটুকুকে চেনা যায়, মুক্তিটুকু থেকে যায় উপলব্ধিতে৷ সেই উপলব্ধিটুকুই সম্বল করে ওই অঙ্কের স্যর হয়তো বুকঠুকেই স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার সাহস ধরেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ছাত্রদের ভালবাসতে পারলে শাসন করা কখনওই অনুচিত নয়৷ শিক্ষকদের বেত্রাঘাত বা চপেটাঘাতকে বড় করে না দেখে, ছাত্রদের বড় হয়ে উঠতে সেই শাসন কী ভূমিকা নিয়েছে তা তলিয়ে দেখা উচিত৷

school children

ছাত্র মানে অনন্ত স্বর্গের রুদ্ধদ্বার, শিক্ষকের দায়িত্ব সেই দ্বারটা খুলে দেওয়া৷ তাতে প্রয়োজনে কঠিন শাস্তি দোষের নয়৷ ‘শাস্তি’ কথাটাতেই প্রবল আপত্তি উঠেছিল৷ আসলে আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে এখনকার বেড়ে ওঠার মধ্যে ‘জেনারেশন গ্যাপ’ স্পষ্ট৷ তা না হলে আজ থেকে বছর দশেক আগেও শিক্ষক মহাশয়ের ‘মার’ নিয়ে এত বিক্ষোভ, আলোচনা, আন্দোলন হত না৷ তখন বোধহয় সমাজ মা-বাবার পরেই শিক্ষককে মানতে শিখিয়েছিল৷ শাসন করতে গিয়ে, বেচাল দেখলে প্রয়োজনে যেমন মা মারতেন, বাবা বকতেন, তেমনই শিক্ষক মহাশয়দের শাসনের অধিকার ছিল৷ তবে এটাও সত্য, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে৷

school children

আজ যাঁদের চল্লিশে চালসে ধরার বয়স, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ছোটবেলায় মাস্টার মশাইয়ের হাতে মার খাননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ মা-বাবারা ভাবতেন, শিক্ষক তো ভালর জন্যই শাসন করছেন৷ ফলে ছেলেমেয়েরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বাড়িতে নালিশ করার প্রশ্রয় পেত না৷ অনেক সময়ই ছাত্ররা ভক্তিতে না হলেও ভয়ে অঙ্কটা শিখে ফেলত, কবিতাটা মুখস্ত করে ফেলত৷ বড় হয়ে অনেককেই বলতে শুনেছি, অমুক স্যরের কানমলা না খেলে সুদকষার অঙ্কটা শিখতে পারতাম না, বা তমুক স্যরের থাপ্পড় না খেলে কেমিস্ট্রির মিস্ট্রি উদ্ধার করাই হত না৷ এতদূর পড়ে মনে হতেই পারে ছাত্রদের মারধর করাকে সমর্থন করতেই এত কথা বলা?

প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে শিক্ষকরা না মারলে কি পড়াশোনা হচ্ছে না? প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’৷ দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ‘নিশ্চয়ই হচ্ছে-আলবাত হচ্ছে’৷ কিন্ত্ত ছাত্র-শিক্ষক সেই আন্তরিক সম্পর্কটা বোধহয় ক্রমেই পাতলা হচ্ছে৷ ছাত্ররা শিক্ষকের উপর অভিমান করতে ভুলে যাচ্ছে, শিক্ষকরা ছাত্রকে চপেটাঘাত করে কাঁদতে ভুলে যাচ্ছেন৷ স্কুলের ভাল ফল হলে শিক্ষকরা গর্ব করতে ভুলে গিয়েছেন, খারাপ ফল হলে বাড়িতে অশান্তি করতেও৷ শিক্ষকদের বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো শিক্ষকতাকে পেশা বলে মেনে নিতে শিখে যাচ্ছেন শিক্ষককুল৷ আর ছাত্র-ছাত্রীরা?

যারা দিনের বেশিরভাগ সময়টা স্কুলে কাটাচ্ছে তারা? পেশাদারিত্বের যুগে আবেগটা হারিয়ে ফেলছে বলেই বাধছে গোলযোগ৷ কত জোরে মারলে তা মনে দগদগে ঘা সৃষ্টি করবে না, আর কতটা শাস্তি দিলে ছাত্ররা নিজের ভুল বুঝতে পারবে সেই সীমারেখাটা ঠিক করে উঠতে পারছে না বোধহয় শিক্ষকশ্রেণির একাংশ৷ তাই কোনও শিক্ষক অমনযোগী পড়ুয়াকে ‘লাথি’ মারতে পারেন, আবার ছাত্ররা কথায় কথায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিতে পারে৷ সমাজ শিখিয়েছে, মা-বাবার মতোই একেবারে উঁচুতে শিক্ষকের আসন পাতা৷ ছেলে বা মেয়ে যদি দোষ করে, অবাধ্য হয় তাহলেও কোনও মা-বাবা কি পারেন নির্মম কোনও শাস্তি দিতে? আবার মা-বাবার শাসনে ছেলে বা মেয়েও কি পারে ঘেরাও করে বিক্ষোভের কথা ভাবতে?

সময় বদলেছে ঠিকই, ছেলেমেয়েদের কেরিয়ারের চাপ বেড়েছে ঠিকই, শিক্ষকদের ব্যস্ততা বেড়েছে ঠিকই কিন্ত্ত দু’পক্ষই যদি সহনশীলতা হারায় তাহলে এই সুন্দর, শ্রদ্ধার, ভালবাসার, আবেগের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে৷ সেই সব শিক্ষকরা আজও আদর্শ যাঁরা সময়ের বিভেদ ভুলে এখনও সিকি শতক আগের শিক্ষকের মতো ক্লাস করতে ঢোকার আগে ক্লাসরুমকে প্রণাম করেন, ছাত্রকে বেত্রাঘাত করার পর তাকে জড়িয়ে কাঁদতে পারেন৷ আবার কাটোয়ার সেই ছাত্ররাও আদর্শ যারা স্কুলের পিয়নকাকুর সঙ্গে শিক্ষকদের খারাপ ব্যবহার দেখে ক্লাস বয়কটের ডাক দিতে পারে৷

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version