বছর শেষে যখন উষ্ণতার পারদ নামতে থাকে। শীতের পরশ নিয়ে এগিয়ে আসে বড়দিন। ঠিক সেই সময়েই কেক উৎসব। ব্রিটিশদের সান্নিধ্যেই এককালে বাংলায় কেকের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা বিদায় নিয়েছে সেই কবে কিন্তু রয়ে গিয়েছে ঐতিহ্য। অতীতে কলকাতায় কেক বলতে লোক মুখে ফিরতো গ্রেট ইস্টার্ন-এর নাম। তখন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বেকারি থেকে পছন্দের ক্রিসমাস কেক কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিত অফিস-ফেরতা মানুষ।তবেপুরনো কলকাতায় কেকের ঠিকানা ছিল ধর্মতলা বা নিউ মার্কেট। সেই হগ মার্কেটের যুগে সুদূর বগদাদ থেকে নাহুম ইজরায়েল নামের এক ইহুদী কলকাতায় এসে কেকের দোকান শুরু করেন। নাহুমস-এর সঙ্গেই কলকাতায় প্রাচীন আমলের আরও দুটি কেকের দোকানের নাম বলতে হয়। মল্লিক কনফেকশনার্স  আর ইম্পিরিয়্যাল বেকার্স অ্যান্ড কনফেকশনার্স। নাহুমের পাশাপাশি এই দুটি দোকানও পুরনো কলকাতার আমল থেকে সুনামের সঙ্গে কেকের ব্যবসা করে আসছে।

এরপর কলকাতার মুখে লেগে গেল ‘বড়ুয়া বেকারি’-র কেকের স্বাদ। দেশ ভাগের অনেক আগেই চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মনোতোষ বড়ুয়া। ফ্রুট কেক, পাম কেক বললেই যে কেউ বলে দিত বড়ুয়া বেকারি। মাত্র ২০ দিন মেলে সেই কেকের দেখা। ৯০ পেরনো বেকারিতে আজও ওভেন নয়, কাঠ কয়লার উনুনেই বানানো হয় কেক। তবে এখনও জৌলুসহীন প্যাকেজিঙে আ্ট থেকে আশি সবার প্রিয় বাপুজি কেক

প্যাকেজিঙের জৌলুস বলতে তেমন কিছুই নেই। কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে বাঙালির আবেগে জড়িয়ে রয়েছে সে। টিফিন কেক বলতেই একটি নামই উচ্চারিত হয়-‘বাপুজি কেক’। শীতল চন্দ্র লাহা ১৯৬৯ সালে বেকারি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বোন অপর্ণা জানা। তখনও ‘দ্যা নিউ হাওড়া বেকারি’-র কেক ‘বাপুজি কেক’ নামে বাংলার মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ঢুক পরে। খেটে খাওয়া মানুষ, ছাত্র-ছাত্রীদের টিফিন বক্সে বাপুজি কেকের চাহিদা এখনও তুঙ্গে। তাই করোনা বাজারেও দৈনিক ৫০ হাজার টিফিন কেক তৈরি করেন তাঁরা।

বাপুজি কেক মূলত বিশেষ ধরনের ফ্রুট কেক। বিভিন্ন ফলের স্বাদের কেক তৈরি করে এই সংস্থা। শুধু টাটকা ফলের স্বাদ আর গন্ধই যে বাপুজিকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে এমনটা নয়, মধ্যবিত্ত বাঙালির পকেটের বন্ধু এই কেকটি।জনপ্রিয়তা বাড়াতে এবং ব্যবসার খাতিরে কোম্পানি বাপুজি কেকের পাশাপাশি বিভিন্ন বিস্কুট ও পাউরুটির প্রোডাকশনের কথাও ভেবেছে। সেই থেকেই বাজারে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট এবং পাউরুটিও বাপুজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে।

বাপুজি বেকারিতে মেশিনের ব্যবহার আছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনও কেক তৈরি হয় সম্পূর্ণভাবে হাতে। রংচঙে নামী কোম্পানির প্যাকেটের পাশে এখনও বাপুজি কেক এখনও সেই একঘেয়ে পুরনো কাগজের মোড়ক, কিন্তু তাতেও ক্রেতাদের যেমন নজর কাড়ছে তেমনই দূষণ আটকাচ্ছে। পরিবেশ-বান্ধব এই ব্যবস্থার অভিনবত্ব সেখানেই। সারা দেশ বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে, আর তার এত বছর আগে থেকেই এই কেক কোম্পানি চোখে আঙুল দিয়ে বিরোধিতা করে চলেছে প্লাস্টিক ব্যবহারের। ঠিক আগেও যেমন তেমনি এখনও বাপুজি কেকের স্বাদ মধ্যবিত্ত থেকে মেহনতি মানুষের অতি প্রিয়। এখনও বহু স্কুলের ছাত্রের টিফিন বাক্সতে ঠাঁই পায় বাপুজি। কারণ মায়েরা চোখ বুজে ভরসা রাখেন বাপুজিতে।

তার মানে এই নেট নির্ভর জীবনেও বাপুজি কেকের প্রতি ভালোবাসাটা কিন্তু একবিন্দুও কমেনি আমাদের। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরনো জীবনে কেবল ভাললাগা নয়, গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে লাল-সবুজ-হলুদ রঙের কাগজের মোড়কে জড়ানো বাপুজি কেকের সেই প্যাকেট। যার চাহিদা আজও অব্যাহত। আর দাম সেও তো সামর্থ্যের মধ্যেই। হয়ত সে কারণেও আট থেকে আশি, যে কারোরই এত পছন্দ বাপুজি। এখনও বহু জায়গার নানা অনুষ্ঠান সে রবীন্দ্র জয়ন্তী হোক অথবা স্বাধীনতা দিবস অংশগ্রহণকারিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বাপুজি কেক। নামী-দামী রকমারি ভীনদেশি কেকের মাঝেও তাই নিজের স্বতন্ত্র এক জায়গা ধরে রেখেছে বাপুজি কেক।

Share.

8 Comments

  1. মধ্যবিত্ত বাঙালির নস্টালজিয়া ! যার জীবনে ক্রিসমাসের নিউমার্কেট ছিল না তার জীবনেও বাপুজি কেক ছিল।

  2. ৩৫পয়সা থেকে এখন সাত টাকা। তাও খাই।প্রায় ই খাই।

  3. Sudipta Mukherjee on

    আগের স্বাদ নেই। তবুও ভাল লাগে। ফ্লেভারটাই নস্টালজিক।

  4. sudipta sanyal on

    আমি এখনও চায়ের ঠেকেই বাপুজি কেক খাই। সাত রূপয়া। আচ্ছা ওই বাগদাদি জিউ পরিবারটা কিভাবে ভারতে সেটল করলো সেটা একবার জানতে সিনাগগ এ ঘোরাঘুরি করেছিলাম তুমি কি ওদের বিষয়ে কিছু জানো ?

  5. Arpita Chatterjee on

    আহা!বাপুজি কেক দেখেই আমার প্রাণ, এক্ষুনি চা চাই চা চাই, করছে।

  6. লেখাটি পড়ে অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, “কমার্শিয়াল”, কিন্তু আমার মতে “ঐতিহ্য বহনকারী কলম”।

  7. ছোটবেলায় আমিও খেয়েছি, এখনও রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে ঢুকলে খাই, কিন্তু কেকের ভিতর থাকা কিসমিসটা মাঝে মধ্যেই “শুটকো” কিংবা “খারাপ” বের হয়। তাছাড়া এখন দেখছি দাঁতের মধ্যেও বিশ্রী ভাবে আটকে যায়, এটা আগে ছিল না। এই যা!

  8. Shrabanti Brishti Mitra on

    একদম মনের মতোন লেখা। তবে নকল বাপুজি থেকে আসল বাপুজি কিভাবে চিনে নেবেন সেই বিষয়ে সতর্কতা দিলে আরো ভালো হতো.

Leave A Reply

Exit mobile version