শ্যুটিং-এ অভিনেত্রী লি না ইয়ং-এর গলায় ফাঁস পরে যায়। মুমূর্ষ অবস্থায় নায়িকাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হল। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি। কিন্তু সেই দুর্ঘটনায় খুবই ভেঙে পড়ড়েন পরিচালক। ক্রমেই আত্মগ্লানিতে ডুবে যেতে থাকেন তিনি। কেবলই তাঁর মনে হতে থাকে তবে কি জীবনের চেয়েও সিনেমাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলছিলেন?  মনে মনে ঠিক করলেন, স্বেচ্ছা নির্বাসন নেবেন। নিজের অসমাপ্ত ছবির কাজ সহকারী পরিচালকদের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। সঙ্গে নিলেন তাঁবু আর ক্যামেরাসহ সামান্য জিনিসপত্র। এভাবেই পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। নিজেই উদ্ভাবন করলেন কফি বানানোর মেশিন এবং টুকিটাকি কয়েকটি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সসপ্যানে রাখতেন বরফ, তা গলে জল হলে তাতে ভাত আর স্যুপ রান্না করতেন। এই ভাবে অনেকটা নিজের সিনেমার মতোই দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। ক্যামেরায় তুলছিলেন নিজের ভেতরকার দুঃখ, ক্ষোভ, আত্মহত্যার প্রবল ইচ্ছাসহ বিভিন্ন দিনলিপি। ঠিক এই ভাবে পেরিয়ে গেল বছর তিন।

অবশেষ নির্বাসন শেষে ফিরে এলেন স্বাভাবিক জীবনে, ফের পা রাখলেন সিনেমা জীবনে। এবার তিনি নিজের নির্বাসনকালে তোলা ছবি ও পরবর্তীতে করা শুটিং সমন্বয়ে তৈরি করলেন ‘আরিরাং’। ছবিটি যেন একটি দুঃখের সুর বা তারই মতো। ছবিতে তিনি কখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, কখনো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন আবার কখনো দেখা যাচ্ছে, কফি বা সেটা তৈরির উপকরণগুলি মিশে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

এর অনেক আগে তিনি বানিয়েছিলেন ‘ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল’, ‘বার্ডকেইজ ইন’,  এর পরে তাঁর বিতর্কিত ছবি ‘দ্যা আইল’, ‘ব্যাড গাই’ ইত্যাদি। ‘দ্যা আইল’ এবং ‘ব্যাড গাই’ নিয়ে ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম ক্লাসিফিকেশন তাঁর বিরুদ্ধে অ্যানিম্যাল ক্রুয়েলটির অভিযোগ জানায়। কারণ, এই ছবিতে নৃশংসভাবে মাছ মারা হয়েছিলো। এ বিষয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, “আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিদিনই খাদ্যের জন্য হত্যা করা হচ্ছে বহু প্রাণীকে। শুধু আমার দেশেই নয়, আমেরিকাতেও গো-মাংস, মুরগী কিংবা পর্কেরচল রয়েছে। তাহলে শুধুমাত্র সিনেমার এই দৃশ্যের প্রতি কেন এত বিরোধ? এটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম। বাস্তব আর সিনেমা, এই দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্যই আমি লক্ষ্য করি না। সুতরাং আমার সিনেমায় এ ধরনের দৃশ্য ভবিষ্যতেও থাকবে।” 

‘স্প্রিং সামার ফল উইন্টার এন্ড… স্প্রিং’- ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের শারিরীক এবং মানসিক পরিবর্তনকে এক সুতোয় গেঁথেছেন তিনি, ‘সামারিটান গার্ল’ এবং ‘৩-আয়রন’-এর জন্য পেয়েছেন বহু পুরস্কার। জীবদ্দশায় ৩৩টি ছবি যার প্রত্যেকটিতেই সতন্ত্রতার ছায়া। অন্যদিকে বিতর্ক। ‘মোবিয়াস’ ছবির শুটং-এ একটি দৃশ্য বোঝাতে গিয়ে তিনি নায়িকাকে চড় মেরে বসেন। যদিও পরবর্তীতে এই ঘটনাটিকে তিনি অভিনয়শিক্ষার অংশ বলেছেন। কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে এমন দুর্বব্যহারের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক অভিনেত্রী তাঁর বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন। কেবল তাই নয় তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছিল। যদিও আদালতে তা প্রমাণিত হয় না কিন্তু সিনেমা জগতের মানুষের চোখে তিনি খুব খারাপ মানুষ হয়ে ওঠেন। অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকা এই সিনেমা নির্মাতার শরীরে অবশেষে বাসা বাঁধে করোনা ভাইরাস। লাটভিয়া হাসপাতালে, ২০২০ সালের ১১ই ডিসেম্বর, মাত্র ৫৯ বছর বয়সেই সিনেমা জগত থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। 

সিনেমা যে কেবলমাত্র বিনোদন মাধ্যম নয় তা তিনি তাঁর প্রতিটি ছবির প্রতিটি শট এমনকি প্রতিটি ফ্রেমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যা দেখতে দেখতে আমরা বিপন্ন বোধ করেছি, বিস্মিত হয়েছি, শিউরে উঠেছি… আমার তো মনে হয় তিনি সিনেমাকে সিনেমার কাঠামো থেকেই বের করে এনেছিলেন। তাঁর ছবিতে ভায়োলেন্স আছে অবশ্যই, কিন্তু অ্যাকশন? একেবারেই নেই। ভালবাসাও আছে কিন্তু তার জন্য কোনো অন্তরঙ্গ মূহুর্ত তৈরি করতে হয়নি। আবার এমন অনেক দৃশ্য রচনা করেছেন যার সামনে আমরা অস্বস্তি বোধ করেছি। এমন অনেক দৃশ্য হাজির করেছেন যা দেখে নিজের মুখ নিজের কাছেই লুকিয়েছি। কারণ তাঁর কথা দিয়েই বলা যায়- “এই সিনেমার মাধ্যমে আমি আসলে প্রশ্ন করতে চাইছিলাম। আমাদের সবার জন্ম একইভাবে। জন্ম হয় সম অধিকার আর সমান গুণাবলি নিয়েই। তাহলে কেন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যকার বিভেদও বাড়তে থাকে?” 

২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবেও তাঁর ‘কল অফ গড’ দেখলাম। আজ সেই বহু বিতর্কিত সিনেমা পরিচালক কিম কি দুকের জন্মদিন। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version