দুদিন আগেই রাজ্য সরকারের দৌলতে সারা বাংলায় ‘খেলা হবে’ দিবস পালিত হয়েছিল। কিন্তু রবিবার সেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পরই ‘খেলা হবে না’ দিবস পালিত হল। যদিও এটার থেকে লজ্জাজনক আর কিছু নেই। কিন্তু খেলার সমর্থকরাই দেখিয়ে দিল খেলা কাকে বলে। কলকাতা দেখলো ফুটবল ম্যাচ থেকেই প্রতিবাদের ঘূর্নিঝড় কিভাবে আছড়ে পড়তে পারে।
শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী কলকাতা ডার্বি। যে ফুটবল ম্যাচ ঘিরে এই বঙ্গের বাঙালি দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। যে ম্যাচ এশিয়ার অন্যতম সেরা ফুটবল দ্বৈরথ, অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান সমর্থকদের আবেগ এবং উল্লাস। যারা সেভাবে ফুটবলের খোঁজ খবর রাখেন না তারাও জানেন, দুটি ক্লাবের সমর্থকরা খেলার আগের দিন থেকেই ঠিক কতটা উত্তেজনা আর আবেগে ভাসতে থাকেন, কী প্রবল উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে তাদের শরীর ও মন। কত কত স্লোগানে ভরে ওঠে শহর, সমর্থকেরা নিজেদের ক্লাব নিয়ে পাড়ার রক থেকে চায়ের দোকান, ঘর থেকে বাইরে মেতে ওঠেন তর্কে। কিন্তু সেই আবেগ, সেই উচ্ছাসে জল ঢেলে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ডার্বি বাতিল হয়। কিন্তু বাতিল হওয়া রবিবারের ডার্বি ফুটবল ম্যাচের সমর্থকেরা এই শহরকে উপহার দিল অন্য এক ফুটবল ম্যাচ। যে খেলা এই শহর এবং শহরবাসী এর আগে কোনোদিন দেখেনি। খেলা ছাড়াই যে সমর্থকেরা তদের আন্তরিক ইছা ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানানোর এমন একটি নজির স্রিষ্টি করতে পারে তা বঙ্গবাসী মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো, স্যালুট করলো গোটা দুনিয়া।
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রবিবার ডুরান্ট কাপের ফাইনাল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একরকম ভয় পেয়েই নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সেই খেলা বন্ধ করে। এতে প্রবল ক্ষুব্ধ হয় কলকাতা-সহ গোটা ভারত এমনকি বিদেশের মানুষও। এমনিতে আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ফুঁসছে গোটা দেশ। খেলার মাঠের গ্যালারি থেকেও সেই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন দুই দলের সমর্থকরা। এতে আরও ভয় পায় প্রশাসন, মিথ্যে ঝামেলার কথা তারা আগেই বলেছিল, এরপর যথেষ্ট পুলিশের অভাব-এই অজুহাতে ঠিক একদিন আগে এই ম্যাচ বাতিল করা হয়। খেলা বাতিলের এই সিদ্ধান্তই যেন সমর্থকদের প্রতিবাদী স্বত্বায় বারুদ ঠেসে দেয়, দুই দলের সমর্থকেরা বাতিল খেলার মাঠে হাজির হওয়ার সিদ্ধানে নেয়। আর সেখান থেকেই এদিন এক অদ্ভূত ছবি দেখা গেল যুবভারতী চত্বরে। এদিন কেউ লাল-হলুদ নয়, সবুজ-মেরুন নয়, সব রঙ মিশে যায় প্রতিবাদের রঙে।
ডার্বি ম্যাচ হলে চলতো বড়জোর দুঘণ্টা কিন্তু প্রতিবাদ হল চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। ম্যাচের আগের দিন থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই দলের সমর্থকরাই স্লোগান লেখা শুরু করেছিলেন, ‘ঘটি বাঙাল এক স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর’, ‘ঘটি-বাঙাল ভাই ভাই, আরজিকরের বিচার চাই।’ এদিন, যুবভারতী চত্বরে জড়ো হওয়া ইস্ট-মোহন জনতার নুখে এই স্লোগানগুলি উচ্চারিত হল প্রতিবাদের স্বরে। কেউ বললেন, ‘তুমি আমি একই স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর’, কেউ বললেন, চিংড়ি-ইলিশ এক স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর, কেউ ‘মাচা-ঘটি একই স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর’, কেউ বা ‘তুমিও তাই, আমিও তাই, আরজি করের বিচার চাই’, ‘ঘটি বাঙাল ভাই ভাই, আরজি করের বিচার চাই’, ‘দুই গ্যালারির একটা স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর’, ‘ঘটি বাঙাল দিয়েছে ডাক, তিলোত্তমা বিচার পাক’।
ডার্বি বাতিল হওয়ার পরই মাঠ দখলের ডাক দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুই দলের সমর্থকরা। কিন্তু, তাতেও বাধা দিতে চেয়েছিল পুলিশ। এদিন বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুবভারতী চত্বরে প্রতিবাদ মিছিল করতে দেওয়া যাবে না। বিএনএসএস-এর ১৬৩ ধারা (আইপিসির ১৪৪ ধারা) অনুযায়ী, সেখানে জমায়েত করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু, তাতে কী ফুটবল প্রেমীদের দমানো যায়, মানুষ তো ন্যায়বিচার চাইবেই। জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে ছাড়েনা। তাতে স্লোগান বদলে, লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন সমর্থকরা আওয়াজ তুললেন, ‘লাঠি চার্জ করবি কর, জাস্টিস ফর আরজি কর’, ‘লাঠির বাড়ি ভয় পেল, ডার্বি বাতিল করে দিল’।
হাজার হাজার সমর্থক জড়ো হওয়ায় পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায় সল্টলেক স্টেডিয়াম। সমর্থকদের দাবি, ‘আজ যে পরিমাণ পুলিশ এসেছে তা দিয়ে অনায়াসেই ডার্বি করানো যেত। তাহলে প্রতিবাদ মিছিল আটকাতে কীভাবে এত পুলিশ এল? এমনকী র্যাফ ও নামানো হল? কীভাবে সেটা সম্ভব হল? পুলিশের তৎপরতা দেখান উচিত ছিল আর জি করে। তাহলে ওই মহিলা চিকিৎসককে ওইভাবে শেষ হতে হত না। সেটা না করে খেলার মাঠে পুলিশ শক্তি প্রদর্শন করতে এল, কিন্তু প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সবাই এক হয়েছে। স্লোগান উঠেছে, ‘যতবার ডার্বি, স্বৈরাচারী হারবি।’ ‘এক হয়েছে বাঙাল-ঘটি, ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি।’