১৯৩১ সালের ১৬ অক্টোবর স্বদেশী মেলা উপলক্ষে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা ছিল, ‘স্বদেশী মেলা, ৩৭ নং বহুবাজার স্ট্রীট অদ্য শুক্রবার, কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথের শুভ পদার্পণ হইবে। মেলা বিকাল ৩টায় খুলিবে, ৬টায় ম্যাজিক, ৭টায় থট্ রিডিং ও ভেন্ট্রিলাকুইজম, ৮টায় বায়োস্কোপ, প্রবেশ মূল্য তিন আনা।’ ‘আজ সন্ধ্যার প্রাক্কালে বায়োস্কোপ দেখিয়া ফিরিবার পথে গোলদীঘির কাছাকাছি আসিয়া কেদারবাবু হঠাৎ গাড়ি হইতে নামিতে উদ্যত হইয়া বলিলেন, সুরেশ, আমি এইটুকু হেঁটে সমাজে যাব বাবা, তোমরা বাড়ি যাও, এই বলিয়া হাতের ছড়িটা ঘুরাইতে ঘুরাইতে বেগে চলিয়া গেলেন।’- শরৎচন্দ্র, ‘গৃহদাহ’। গত শতকের ৭০ এর দশকেও শহরে ও গ্রামে কাঁধে বায়স্কোপ নিয়ে বায়োস্কোপওয়ালাকে ঘুরতে দেখা যেত। আর বায়োস্কোপ বাক্সের চলমান ছবি দেখার জন্য মা-বাবার কাছে আবদার করছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেদিনের বাংলার বিনোদনের এই লোকজ মাধ্যমটি হারিয়ে গিয়েছে।

ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে স্টিফেন্স নামে এক বিদেশি কলকাতায় এসেছিলেন। তিনিই প্রথম কলকাতায় বায়োস্কোপ দেখান। এর বছর দুই পরে তাঁরই অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। একসময় বায়োস্কোপওয়ালারা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যেতেন বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে নিয়ে। তাঁদের পিছু নিত শিশু–কিশোরেরা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ এখন পুরোপুরি লুপ্ত। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে গ্রামবাংলার বিভিন্ন মেলা, বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন বায়োস্কোপওয়ালারা। তাঁদের বিভিন্ন ধরনের গানের মাধ্যমে আকৃষ্ট করতেন ছোট–বড় বিভিন্ন বয়সী মানুষকে। তখন এমন এক সময় ছিল, যখন মানুষের একমাত্র বিনোদন ছিল যাত্রাপালা–সার্কাস। কিন্তু যাত্রাপালা–সার্কাস ছিল শুধু বয়স্ক মানুষের জন্য আর বায়োস্কোপ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। বায়োস্কোপ বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের নাম। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে ছবি দেখার দৃশ্য নগরজীবনে আর চোখেই পড়বে না। ‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল…’ এই সুর আর ছন্দের তালে তালে সেই বায়োস্কোপওয়ালার ধারাবিবরণী আর কোনোদিনই শোনা যাবে না। 

কিন্তু সেই বায়োস্কোপওয়ালা একদিন তার চিরাচরিত আওয়াজ দিয়ে ছেলেপুলেদের হেকে-ডেকে জড়ো করতেন, ছড়া-ছন্দে আকর্ষণীয় বাক্য বলতেন আর হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেন বাক্সের ভিতরের রঙিন ছবি। খঞ্জনি আর গানের তালে তালে বাক্সের ভেতরে একটার পর একটা ছবি পাল্টে যেত। আর তা দেখে যেন গল্পের জগতে হারিয়ে যেত বাচ্চা বুড়ো সবাই। তবে একসঙ্গে সবাই দেখতে পেতো না, একজনের পর একজন; এক পয়সা, দুই পয়সা কিংবা চার আনা, আট আনা দিয়ে দেখতো ঘাড় নিচু করে, কোমার বাঁকিয়ে, দুই চোখের দুই পাশে দুই হাত রেখে কয়েক মিনিট ধরে একটানা দেখতো আর কান দিয়ে শুনতো বায়োস্কোপওয়ালার ছান্দসিক বাক্য- এই দ্যাখেন ভাই…, এই দ্যাখেন ভাই… ইত্যাদি। তখন ওই রঙিন ছবিগুলিই শিশু কিশোর দর্শকপ্রাণে শিহরণ জাগাতো, অন্য রকম অনুভূতির সঞ্চার করতো। কারণ তখন ওটাই চিত্ত বিনোদনের একমাত্র আধুনিক মাধ্যম। আজ সেই দেশীয় সংস্কৃতির মাধ্যমটি বিলুপ্ত ঐতিহ্য।

তখন জনপদজুড়ে নানা বিনোদনের আয়োজন ছিল না। তবে গান-বাজনা ছিল, পুতুলনাচ, যাত্রাপালা ছিল, তবে বায়োস্কোপের আকর্ষণ ছিল একেবারেই অন্য রকম। আজকের প্রজন্মের মানুষের কাছে বিশেষ করে শহরের ইটকাঠকংক্রিটবন্দী জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষের কাছে বায়োস্কোপ হয়তো হাস্যকর এক বোকা বাক্স। কিন্তু বায়োস্কোপ মোটেও তা নয় এমনকি বোকা বাক্সও ছিল না! প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপ ছিল গ্রামবাংলার সিনেমা হল। গ্রাম শহরের রাস্তা ধরে হ্যামিলনের মতো চলতো বাঁশিওয়ালা আর তার পেছন পেছন বিভোর স্বপ্ন নিয়ে দৌড়তো ছোট ছেলেমেয়েরা। বায়োস্কোপে ছবি দেখার মজাই ছিল আলাদা! কেবল ছোটরা কেন, বাংলার গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনের বায়োস্কোপ নানা বয়সের মানুষকে আনন্দ দিতো, আলোড়িত হত সেই সময়, সেই জীবন। স্যাটেলাইট সভ্যতায় সেই জীবন বা আনন্দের কল্পনা করা যায় না।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version