প্রায় ন’লক্ষ মানুষ তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ডিসেম্বর মাসের কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো বিষাক্ত গ্যাস। ঘন্টায় ১২ কিমি গতিতে ছুটতে শুরু করলো সেই বাতাস।তার সঙ্গেই ছুটতে থাকলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মৃত্যু অথবা আধা মৃত্যু।সেই বাতাস সময়ের আগেই পৌঁছে গেল ঘুমন্ত মানুষের ঘরের ভিতর। কোনোভাবে সতর্ক হওয়ার আগেই আক্রান্ত হয়ে পড়লো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষ। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তাদের। চোখের পাতা খুলতেই দেখলো প্রতিটি ঘর ধোঁয়াচ্ছন্ন। শুরু হল চোখ জ্বলা আর যন্ত্রণা। শিশুরা নিজেদের গলা চেপে ধরে কেশেই চলেছে।দুই চোখ জ্বলে যাচ্ছে,যন্ত্রণায় কান্না কিংবা চিৎকারও বন্ধ।কণ্ঠনালী পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কেউবা পেট চেপে ধরে বসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে।

ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘরের বাইরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কেউ পারছে, তো কেউ চৌকাঠ পর্যন্ত যেতে না যেতেই লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। একনাগাড়ে কাশির শব্দ আর ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার অজানা কষ্টে তখন ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল। একটু শক্তপোক্ত যারা সেই সব মানুষ কড়িকাঠ মাড়িয়ে বাইরে আসতে পেরেছিল। কিন্তু হতভাগ্য লোকদের চারপাশ তখন বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনও ছিল না সে রাতের বাতাসে। রাস্তার ধারে পড়ে ছিল কাঁথা মুড়ি দেওয়া শত শত লাশ। চোখে ভয় আর মুখে ফেনা নিয়ে সবার আগে মারা যাওয়া এই গৃহহীনদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছিন্নমূল পথশিশু।

ইতিমধ্যে ঘিঞ্জি বস্তিগুলিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে থাকে। কিন্তু কোন দিকে ছুটবে। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া।বিষাক্ত গ্যাস দ্রুত চারপাশ গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু তাকে বাঁচতে হবে, সেই বাঁচার পথ কোথায়! তাই অজানার দিকে ছুট।দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে ওঠা মাও জানেন না, তার কোলে থাকা আদরের ধন অনেক আগেই মারা গিয়েছে। সদ্য লাশ হয়ে যাওয়া মা-বাবার পাশেই চোখে একরাশ দগ্ধ জ্বালা নিয়ে ছোট্ট শিশুটিও কাশতে কাশতে এক সময় চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোপাল রেলস্টেশনে রাত ১টা বেজে ১০ মিনিটে পৌঁছনো লক্ষ্ণৌ-মুম্বাই এক্সপ্রেস ট্রেনটিও বিভীষিকার ঘন সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ‘ডমিনোস ইফেক্টের’ মতো মানুষ সারি সারি লাশে পরিণত হয় ভোপালের রাস্তায়, বাড়িতে, গাড়িতে, রেলস্টেশনে এবং সর্বত্র।

গ্রিনপিস (পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন)-এরমতে, ভোপালের ঘনবসতিপূর্ণ ৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ওই গ্যাসে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ৭২ ঘন্টায় অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে প্রাণ হারায় ৮ হাজার নিরীহ মানুষ। অন্যদিকে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক, যার প্রায় দুই লক্ষই ছিল ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। অবশ্য তৎকালীন সরকারের মতে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিতে মৃতের সংখ্যা ৫,২০০ জন!বেঁচে থাকা স্বজন ও প্রশাসন কয়েকদিন ধরে লাশের সৎকার করতে করতে হিমশিম খেয়ে যায়। তারপর সাদা কাফনে মোড়ানো সারি সারি লাশগুলোকে বাধ্য হয়ে একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়। শ্মশানে একসাথে পোড়ানো হয় শত শত লাশ। অমর চাঁদ আজমেরার মতো সমাজসেবীদের দিনে প্রায় দু হাজারের মতো লাশের সৎকার করতে হয়েছিল। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল শোকের জনপদ ভোপাল।

এতবড় বিপর্যের জন্য যে ইউনিয়ন কার্বাইড প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, সেই সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি অ্যান্ডারসনকে দুর্ঘটনার পর পরই গোপনে, অতি সযত্নে তখনকার রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারসরকারি বিমানে দিল্লিতে এনে ভারত থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়৷ তারা এই মারাত্মক দুর্ঘটনার পরিণাম আঁচ করেছিলবলেই হয়ত অ্যান্ডারসনের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছিল। আর সে কারণেই আদালতে মামলা ওঠার পর অভিযু্ক্তদের কাউকে হাজির করা যায়নি৷ উলটে তাঁদের বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবার জন্য সরকারের তরফে আন্তর্জাতিক বিধিনিয়মের সাফাই দেওয়া হয়৷ বলা হয়, এর জন্য দরকার প্রত্যর্পণ চুক্তি৷ এক রাতে হাজার হাজার মানুষকে যারা খুন করলো, কয়েক হাজার মানুষকে যারা অর্ধ মৃত করলো তাদের বাচাতে কী অসাধারণ যুক্তি তাই না! গত ৩৮ বছরে রাজ্যে (মধ্যপ্রদেশ) ও কেন্দ্রে কত সরকার এলো, কত সরকার গেল, কেউ ভোপাল নিয়ে একটি কথাও বলেনি, শোনেনি, কেউ কথা রাখেনি৷ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেই চলেছে৷

ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় বেসরকারি হিসেবে মারা যায় প্রায় ২৪-২৫ হাজার মানুষ৷ দেহে নানান দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয় প্রায় পাঁচ লাখের মতো৷ ২০০১ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কিনে নেয় আরেক আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ডো কেমিকেলস৷ তাদের নীতি স্রেফ মুনাফা, ক্ষতিপূরণের দায় নিতে তারা অস্বীকার করে৷ মানবিকতার দায় তো দূর অস্ত৷ এমনকি ঐ কারখানার বিষাক্ত মাটি ও ভূগর্ভস্থ জল শোধন করারও কোনো উদ্যোগ নেয়নি ডো কেমিকেলস৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ তারাই বা কি ভুমিকা নিয়েছে?ন্যায়বিচার শব্দটির মানে হয় পালটে গিয়েছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version