যে কোনো জাতির সাধারণ একটি পরিচয় মেলে তার খাদ্য সংস্কৃতি থেকে। যেমন বাঙালির পরিচয় পাওয়া যায় তার মিষ্টির পসরায় চোখ রাখলে। সন্দেস, রসোগোল্লা, চমচম, পান্তুয়া, রাবরি, লেডিকেনি…এরকম আরও কিছু মিষ্টির নাম ঊল্লেখ করাই যায় তবে সবকিছুর পর বাঙ্গালির পছন্দের মিষ্টি বলতে যে নামটি করতে হয় সে হল দই। নিমন্ত্রণ বাড়িতে যতই কবজি ডুবিয়ে খান না কেন, শেষ পাতে দই না পেলে কিন্তু খাওয়াটা ঠিক জমে না। কেবল তাই নয়, বাঙ্গালির যে কোনও শুভ অনুষ্টান; পুজোপাব্বন থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশন, বিয়ে সবেতেই দরকার পড়ে দই। আর এই রীতির প্রভাব থেকেই আমরা ভেবে নিই দইয়ের উৎপত্তি হয়তো এই মাটিতেই। কিন্তু ওই ধারণা অত্যন্ত ভুল।

দইয়ের পরিচিতি গোটা দুনিয়া জুড়ে। দুগ্ধজাত এই খাবারটির বয়স কমপক্ষে চার হাজার বছর তো হবেই। তবে দইয়ের উৎপত্তি কিন্তু এই দেশে এমনকী বঙ্গদেশেও নয়। এরপরের প্রশ্ন তাহলে প্রথম কোন দেশে দইয়ের উৎপত্তি?  দুধ ও ব্যাকটেরিয়ার যুগলবন্দীতে তৈরি এই খাবারটির সঙ্গে পরিচয় ঘটল কোন দেশের দৌলতে? ফুটবলার রিস্টো স্টয়চকভের নাম যারা জানেন তারা নিশ্চয় এটাও জানেন স্টয়চকভের কোন দেশের খেলোয়ার-হ্যা বুলগেরিয়া, আর সেদেশে দই ছাড়া মানুষের একমুহূর্তও চলে না।

দইয়ের বীজাণুর নাম হল ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ। নামের মধ্যেই তো দেশটির সংস্পর্শ টের পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বুলগেরিয়ার প্রায় সব খাবারেই আপনি দইয়ের স্বাদ পাবেন। সেটা শুধু এক পদের দই নয়, নানা পদের নানা স্বাদের দই। যেমন ধরুন, বুলগেরিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার ট্যারাটর নামের ঠান্ডা স্যুপ যার মূল উপাদান হল দই। বুলগেরিয়ানরা সব সময়ের খাওতেই দই ব্যবহার করে। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে দুপুরবেলার খাওয়া, সন্ধ্যেবেলা স্ন্যাকসের সঙ্গেও এমনকী রাতের খাবারেও তারা দই খুবই পছন্দকরে।

কিন্তু বুলগেরিয়ায় দই এল কীভাবে। বুলগেরিয়ার খাদ্য সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যাছে প্রায় চার হাজার বছর আগে যাযাবর জাতি নোমাডিক-দের হাত ধরে সে দেশে দইয়ের প্রচলন। এখানকার প্রাচীন বাসিন্দা নোমাডিকরা দুধ রাখত প্রাণীর চামড়া দিয়ে বানানো থলি বা ব্যাগে। যা ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টির পক্ষে আদর্শ পরিবেশ এবং সেই ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে গাঁজন প্রক্রিয়ায় থলিতে রাখা দুধ হয়ে যেত দই। ঐতিহাসিকদের মতে, সমসাময়িক সময়ে একইভাবে হয়তো আরও কিছু অঞ্চলে দইয়ের প্রচলন ঘটে। সেদিক থেকে প্রথম দই বানানোর দাবিদার নিশ্চিতভাবেই মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া আর বুলগেরিয়ার বাইরে নয়। সে যে অঞ্চলই হোক না কেন, বুলগেরিয়া যে বাণিজ্যিকভাবে পশ্চিমী দেশগুলোকে প্রথম দই খাইয়েছে, তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। পৃথিবীকে দই চেনানো দেশটিও তো বুলগেরিয়া।

দইয়ের গুপ্ত রহস্য প্রথম ভেদ করেন বিজ্ঞানী ড. স্টামেন গ্রিগোরভ। ১৯০৪ সালে বিয়ের কিছুদিন পর জেনেভার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন গ্রিগোরভ। তখন তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সঙ্গে ছিল রুকাটকা নামের মাটির পাত্রে বানানো দই। পরীক্ষাগারে সেই দই নিয়ে এক বছর ঘাম ঝরানোর পর গ্রিগোরভ আবিষ্কার করেন, গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ থেকে দই হতে ঠিক কোন ব্যাকটেরিয়া দায়ী। ইউনিভার্সিটি অব প্লোভডিভের জাতিতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইলিতসা স্টোইলোভা বলেন, এটা ঠিক যে বলকান অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় দই এবং লস্যি থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে দই এবং লস্যি তৈরি হলেও বুলগেরিয়ায়  নির্দিষ্ট একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এবং পদ্ধতি অনুসরণ করতে না পারলে এর গুনগত মান অক্ষুণ্ন রাখা যায় না। পশ্চিমীদের কাছে দই এবং লস্যি জনপ্রিয় করে তুলতেও অতি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বুলগেরিয়া।

গ্রিগোরভ এবং বুলগেরিয়ানদের দইপ্রীতির সম্মানে সেই বীজাণুটির নাম রাখা হয়-ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ। এতে দইয়ের সঙ্গে বুলগেরিয়ার সম্পৃক্তি টেকসই ভিত্তি পেয়ে যায় চিরকালের মতো। শুধু তা-ই নয়। গ্রিগোরভের এই আবিষ্কারকে সম্মান করে তাঁর জন্মভূমি বুলগেরিয়ার ত্রার্নে-তে একটা জাদুঘরও বানানো হয়-এটা দই নিয়ে পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর। দইয়ের ব্যাপক চাহিদার জন্য ১৯৫৯ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ডেইরি ইন্ড্রাস্ট্রিজ তৈরি হয় বুলগেরিয়ায়। দই এবং লস্যি হয়ে উঠেছে বুলগেরিয়ানদের জাতীয় প্রতীক।

Share.

1 Comment

  1. নতুন একটা বাংলা শব্দ ও শিখলাম। গাঁজন কথাটা আগে এভাবে ব্যবহার দেখিনি। Thank you.

Leave A Reply

Exit mobile version