বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে যত রকম সবুজ কার্যক্রম চলে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল গাছ লাগানো। উল্লেখ্য, জুন মাস আমাদের দেশে গাছ লাগানোর জন্য সেরা সময়। তাই বৃক্ষরোপণ পরিবেশ দিবসের সবচেয়ে পছন্দের কার্যক্রম। সরকারী তথ্য অনুসারে, জুন-জুলাই মাসে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগানো হয় কিন্তু তারপর কী হয়? সমস্ত রোপণ করা চারাগুলির কী হয়? তাদের মধ্যে কতজন বেঁচে থাকে? কোনো তথ্য আমাদের কাছে আছে কি? তাছাড়া, এই সমস্ত প্রশ্নের মধ্যে, সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি হল ‘পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কি কেবল বৃক্ষরোপণই একমাত্র সমাধান?’ কোটি কোটি গাছ লাগালেই কি জলবায়ু পরিবর্তন আটকানো যাবে? তবে কখনই বলছি না যে গাছ লাগাবেন না। আবার একটি সেভ ট্রি টি-শার্ট পড়ে আপনি গাছ লাগাতে লাগাতে যদি ভাবেন যাক, জলবায়ু পরিবর্তন আটকে দিলাম! সেটাও কিন্তু ঠিক হবে না। গাছ লাগান বায়োডাইভারসিটির জন্যে, গাছ লাগান কাঠ ছাড়াও হাজার একটা জিনিস আমরা গাছ থেকে পাই বলে, গাছ লাগান শীতল ছায়ায় জন্য, পাখির ডাকের জন্য, আর রোজগারের উপায়ের জন্য।

আসলে গাছ লাগাও প্রাণ বাঁচাও জাতীয় স্লোগান শুনতে শুনতে মনে হতেই পারে যে গাছ লাগানোটাই একমাত্র সমাধান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি বিষয় যে গাছ লাগিয়ে ফেললেই যে একে আটকানো যাবে সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিছু বৈজ্ঞানিক আবার এক ধাপ এগিয়ে এমনও বলছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন আটকানোর জন্য দয়া করে গাছ লাগাতে যাবেন না। তাহলে কি আমরা ছোটবেলা থেকে যা পড়লাম, যা জানলাম তা ভুল! প্রথমে দেখা যেতে পারে নাদিন ঊঙ্গার ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে ‘পৃথিবী কে বাঁচাতে হলে দয়া করে গাছ লাগাবেন না’ শিরোনামে কি লিখেছেন। কে এই নাদিন ঊঙ্গার, তিনি এক্সটার ইউনিভার্সিটির একজন বৈজ্ঞানিক। তিনি তাঁর যুক্তিকে পদার্থ বিদ্যার প্রাথমিক একটি নিয়মের উপর দাঁড় করিয়ে বলছেন, পৃথিবীর উষ্ণতা নির্ভর করে কতটা পরিমাণ সূর্যালোক পৃথিবীতে পড়ছে এবং কতটা ফিরে যাচ্ছে তার উপর। যেহেতু গাছ একটি গাড় রং এর পদার্থ ফলে সে সূর্যের শক্তি বেশি শোষণ করবে। ২০০৭ সালের ইউরোপ এবং কানাডার বিজ্ঞানীদের একটি একটি গবেষণা অনুযায়ী ট্রপিকাল রিজিয়ন হল গাছ লাগানোর জন্য সবথেকে আদর্শ জায়গা। কারণ এখানে গাছ তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে এবং সবথেকে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। কিন্তু তারা এটাও দেখিয়েছিলেন যে মেরু প্রদেশে গাছ লাগানোর ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে যেতে পারে। তাদের কথা অনুযায়ী গাছ লাগানো জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে সাহায্য করবে যদি সেই গাছ ঠিকঠাক জায়গায় লাগানো হয়। নাদিন ঊঙ্গারের গবেষণা আরও বলছে যে গাছ থেকে ভিওসি নামের একটি গ্যাসিয় কেমিক্যাল বের হয় যা কিনা পরবর্তীকালে মিথেন এবং ওজনের মত গ্রীন হাউজ গ্যাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। নাদিন ঊঙ্গারের গবেষণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, গাছ লাগানোর জন্য সরকারি সাহায্য পাওয়া যায় কিন্তু জঙ্গল বাঁচিয়ে রাখার জন্য নয়। তাই অনেক জায়গায় গাছের মালিকরা স্থানীয় গাছের বদলে সেই জায়গায় লাভজনক গাছ লাগাতে শুরু করেন।

একটি এনজিও ২.১ কোটি গাছ মূলত ট্রপিকাল রিজিয়নে লাগানোর পরিকল্পনা নেয়। সংখ্যাটি বিরাট কিন্তু বাস্তবতা হল ২.১ কোটি গাছের বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড কমানোর ক্ষমতা ১০ বছরে ৪০ লক্ষ টন এর কাছাকাছি। শুধুমাত্র ২০১৯ সালে গোটা পৃথিবী থেকে ৪৩.১ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছে। (এক হাজার মিলিয়নে এক বিলিয়ন)। তার মানে অত কোটি গাছ লাগিয়ে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানোর চেষ্টা সমুদ্র বা দীঘি থেকে এক বালতি জল তোলার মতো। আরেকটি পরিসংখ্যান, ২০১৯ সালে অ্যামাজন ওয়াইল্ডফায়ার ১০০০ মিলিয়ন গাছ পুড়ে গিয়েছে। ২০২০তে অস্ট্রেলিয়ান বুশফায়ারে ১০০০০ মিলিয়ন গাছ পুড়ে গিয়েছে। ডিফরেস্টেশন বা গাছ কাটা কিংবা জঙ্গলে আগুন যদি আটকানো যায় সে ক্ষেত্রে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১০ শতাংশ কমে যাবে। আমরা গাছ লাগিয়ে যতটুকু চেষ্টা করছি তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি করছি যে গাছগুলি এখনও বেঁচে আছে তাদেরকে রক্ষা না করে।বিশ্বজুড়ে প্রবল পরিমাণে গাছ লাগাবার একটা আন্দোলন চলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ জায়গাতেই এক বিশেষ প্রজাতির গাছি প্রচুর পরিমাণে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন গোটা বাংলা জুড়ে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস, তারও আগে ব্রিটিশরা গোটা দার্জিলিং জুড়ে জাপানি সিডার বা ঝুপি গাছ লাগিয়ে গিয়েছিল। কোনটিরই কিন্তু বর্তমান ফলাফল ভালো হয়নি। মনোকালচার বা একই রকমের গাছ লাগানো পরিবেশের জন্য অত্যন্ত খারাপ খবর নিয়ে আসতে পারে। এবং এটা পরীক্ষিত সত্য যে মনোকালচার ফরেস্ট কখনোই বায়োডাইভারসিটি-বান্ধব নয়।

সাধারণত দেখা যাচ্ছে যে, চারাগাছ জলের অভাব বা পোকামাকড়ের আক্রমণ ইত্যাদির ফলে বেঁচে থাকার হার মাত্র ২৫%। অর্থাৎ চারটি গাছ লাগালে একটি পূর্ণবয়স্ক হয়ে উঠছে। এই পূর্ণবয়স্ক গাছ, বৃক্ষরোপণের ১৫ থেকে ৩০ বছর পরে বাতাস থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে। অর্থাৎ গাছ আজ লাগালে তার কার্যকরী ক্ষমতা হতে প্রায় তিন দশক লাগতে পারে। তবে গাছ ততক্ষণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে যতক্ষণ সে জীবিত। গাছের মৃত্যুর পরেও কিন্তু আণুবীক্ষণিক জীবেরা গাছের কাঠে সঞ্জিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আবার বাতাসে ফিরিয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়তে নতুন গাছ লাগাবার আগে পুরনো গাছগুলিকে বা জঙ্গলগুলিকে যথাযথ সংরক্ষণ করার দরকার। তাহলে কি গাছ লাগা্বো না? অবশ্যই লাগাবো কারণ, গাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাস্তুতন্ত্র, আমাদের জীবিকা, ভূমিক্ষয় রোধ করে গাছ, আরবান হিট আইল্যান্ড বা শহরের উষ্ণ দ্বীপপুঞ্জ গুলি থেকে মানুষকে রক্ষা করে গাছ, কাঠ ছাড়াও হাজার একটা প্রডাক্ট বা বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী গাছ থেকে আমরা পেতে পারি। নতুন রাস্তা, নতুন কারখানা বানানোর নামে হাজারটা গাছ লাগান অজুহাতে পুরনো দশটি গাছ কেটে ফেলা একেবারেই ঠিক নয়। নতুন জঙ্গল বসানোর প্রতিশ্রুতিতে পুরনো জঙ্গল কেটে ফেলা বৈজ্ঞানিকভাবে কাম্য নয়। মাথায় রাখতে হবে যে গাছ জলবায়ু পরিবর্তনের হার সামান্য কমাতে পারে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করতে পারেনা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের অরণ্য রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণ সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
