সভ্যতার প্রায় শুরু থেকেই মানুষ নানা রকমের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তো। প্রথম দিকে সেই দ্বন্দ্ব ছিল গোত্রে গোত্রে, তাতে মানুষে মানুষে অশান্তি হত, খুনোখুনিও চলতো, শেষমেশ অশান্তি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হল। সময়ের পরিক্রমায় দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল এবং অশান্তি-দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ অন্তঃরাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়লো। এরও বহুকাল পর বিশাল ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করল মানবসভ্যতা। ১৯১৪ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৭-২০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণনাশ হল। কেবল তাই নয়, তার সঙ্গে কত মানুষ যে ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বশান্ত এবং পঙ্গু হল তার সঠিক তথ্য দেওয়া কঠিন। আরও ভয়ঙ্কর ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি। কেবল এইটুকু বলা যায় ১৯৪০ সালের সেই যুদ্ধে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা (২. ৩ বিলিয়ন)-এর প্রায় ৩ শতাংশ প্রাণ হারায়, অর্থাৎ ৭০-৮০ মিলিয়ন। উল্লেখ্য, যুদ্ধে হতাহতদের সংখ্যা সবসময়েই অনুমান করা হয়ে থাকে। কারণ, প্রকৃত সংখ্যা হিসাব করা সম্ভব নয়। যুদ্ধে সরাসরি মৃত্যুর বাইরে মহামারী, খাদ্যাভাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে অনেক মানুষ মারা যায়। সেই হিসাব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিসাবে আনা হয় না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা ফেলা মানবসভ্যতার উপর জঘন্যতম আঘাত, সেই ক্ষত কি মানুষ কোনোদিন ভুলতে পারবে? কত মানুষ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমের তেজষ্ক্রিয়ার শিকার হয়েছে এবং কয়েক বছর পর মারা গিয়েছে সেই তালিকাও কি সম্পূর্ণ জানা যায়? দুনিয়া কি আমেরিকার ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় হামলার কথা ভুলে গিয়েছে? ১৯৬৫-৭৫ সাল পর্যন্ত সেই দীর্ঘ যুদ্ধে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সেখানেই শেষ হয় না, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পুরনো গোলাবারুদ থেকে মারাত্মক দুর্ঘটনায় ৪২ হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। উত্তর ভিয়েতনামে আমেরিকার সেনাবাহিনী ১৫ মিলিয়ন টন বোমা ও বিস্ফোরক ব্যবহার করেছিল, যার থেকে প্রায় আট লক্ষ টন সময় ভিয়েতনামের মাটি, জল ও বায়ুকে দূষিত করে এবং প্রাণসংহার করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাও বলা যায়। ন’মাসের ওই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব বাংলার ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল, বাস্তুহারা হয় কোটি মানুষ, ধর্ষিত হয় লক্ষ নারী। এই দুনিয়া শক্তি আর ক্ষমতা দেখাতে কেবল টাকা নয়, ব্যবহার করছে বহু মেধা পাশাপাশি বহু শিশু-কিশোরের স্বপ্নকে কোরবানি দিচ্ছে।

দুনিয়াজুড়ে কোনো না কোনো যুদ্ধ লেগেই আছে। আর যুদ্ধ মানেই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার। যুদ্ধ কিংবা শান্তি, যেকোনো পরিস্থিতিতে সমরাস্ত্র তৈরি এবং মজুদ একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার এবং দেশগুলির সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এটা চালিয়ে যায়। বেঁচে থাকার জন্য যতটা ব্যয় তার চেয়ে বেশি যুদ্ধ আর ধ্বংসের জন্য। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে, কবে শেষ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধে কোন দেশ কত বড় আক্রমণ করল কিংবা কে কতটা এগিয়ে অথবা পিছিয়ে সেসবের ভিড়ে কত হাজার বাস্তুহারা কিংবা স্বজনহারা হল, কত হাজার পঙ্গু অথবা প্রাণ হারালো তার হিসাব রাখা হয়না। তাই প্রশ্ন করাই যায়, একবিংশ শতাব্দীর এই তথাকথিত মানবসভ্যতায় ফিলিস্তিনের গাজায় যে শিশু, নারী হত্যা চলছে এবং সভ্য হিসেবে দাবি করা জাতিগুলি তা চেয়ে চেয়ে দেখছে এবং যারা মানবাধিকারের কথা বলছে তারা কি সবাই মানবসম্প্রদায়ের সদস্য?

যুদ্ধের ফলে গাজায় মারাত্মক মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের বোমা উড়িয়ে দিতে হাসপাতাল থেকে স্কুল, শরণার্থী শিবির কোনো কিছু বাদ রাখছে না। প্রতিদিন শত শত শিশু ও নারীর মৃত্যু হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পতনের অবস্থায়, বেশির ভাগ হাসপাতাল পরিষেবার বাইরে এবং পানীয় জল, খাদ্য, জ্বালানি ও চিকিৎসা সরবরাহের ঘাটতি তীব্র আকার নিয়েছে। বোমা-গুলির আঘাতে আহত বেসামরিক নাগরিক চিকিৎসা না পেয়ে অসহনীয় যন্ত্রণায় মারা যাচ্ছে। ইসরায়েলি সেনা গাজায় জল, জ্বালানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ওই অঞ্চলে অনাহার ও রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার কথা বলছে জাতিসংঘ। তারা কেবল অসহায় বাণীই প্রকাশ করছে আর অমানবিক পৃথিবী চোখ-কান সব বন্ধ করে আছে। কী অসহায় পরিহাস! যাদের দেশ, যাদের জন্মভূমি তারাই বছরের পর বছর দখলদারদের হাতে মার খাচ্ছে, খুন হচ্ছে, বাস্তুহারা হয়ে সারা বিশ্বে শরণার্থীর পরিচয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

প্রশ্ন, তাহলে এতসব মানবাধিকার, মানবতা তা কেবলই কথার কথা? মানবতা, মানবাধিকার আশা করা গেলেও তা মেলে না কারণ, সেই মানুষ আর নেই। যদি থাকত তাহলে এত নিরীহ মানুষ হত্যা হত না। যুদ্ধ বা মানুষ হত্যার পিছনে তো দখলদার আর তাদের রাজত্ব কায়েমই মুখ্য বিষয়? ক্ষমতাধর হয়ে, রাজ্য দখল করে, লোক খুন করে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার ফলাফল কী? যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস সবই সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য কিন্তু যখন সব শেষ হবে তখন তাদের আর কী করার থাকবে? সাম্রাজ্য লাভের আনন্দ নিয়ে বিশ্রাম? যদি তাই হয় তবে শেষ আনন্দ শুরু থেকে নয় কেন? কী লাভ এত হত্যা আর ধ্বংস চালিয়ে? এত মানবাধিকারের স্লোগান, মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী এত সংস্থা, সংগঠন এসবের কাজ কী?