বারবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে কলকাতার বহু বাড়ি, হোটেল, বাজার, হাসপাতাল তার সঙ্গে প্রাণ গিয়েছে নারী-শিশু সহ অসংখ্য মানুষের। প্রত্যেকবার প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি আর মৃত্যু শোক শহরবাসীকে বেআইনি নির্মান, দাহ্যবস্তু সংরক্ষণ, যত্রতত্র এবং যথেচ্ছভাবে বৈদ্যুতিক তার সম্পর্কে সতর্ক করলেও অগ্নিকান্ড থামানো যায়নি। তাই ফের একবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কলকাতার বুকে দগদগে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিল। শহরে ফিরল স্টিফেন কোর্ট, আমরির ছায়া। মঙ্গলবার রাতে বড়বাজারের একটি হোটেলে আগুন লেগে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগুন লাগার ঘটনায় বগু অভিযোগ উঠেছে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠছে হোটেলের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে নিরাপত্তা নিয়ে। তার থেকেও বড় প্রশ্ন বে-আইনি নির্মাণ নিয়ে। কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর ঘটনার পর থেকে হোটেলের মালিকের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

খোদ দমকল মন্ত্রীর বক্তব্য, আগুন লাগার ঘটনায় হোটেল কপক্ষের প্রচুর গাফিলতি ছিল। হোটেলে আগুন নেভানোর যেটুকু ব্যবস্থা ছিল তার কোনোটাই কাজ করেনি। তাছাড়া গোটা হোটেল ভবনটি কাঁচ দিয়ে ঢাকা থাকায় আগুন বা ধোঁয়া বের হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সেই কারণে দমবন্ধ হয়ে লোকজন মারা গিয়েছে। আগুন নেভানোর সময় ভিতরে ঢুকতে দমকল কর্মীদের কাচ ভাঙতে হয়েছে। জলের যে ট্যাঙ্ক ছিল সেখান থেকে জল নিয়ে শুরুতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে হোটেলের লোকজন। কিন্তু সেখানেও পর্যাপ্ত জল ছিল না। মোট কথা হোটেলের ভিতরের অবস্থা এমন ছিল যে দমকল কর্মীদের ভিতরে ঢুকে আগুন নেভাতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। কাচে মোড়া গোটা হোটেল। তাতেই আগুন যেমন বাইরে বেরতে পারেনি, তেমন মানুষও। ১৯৯৩ সালে ৬ নম্বর মদনমোহন বর্মন লেনে তৈরি হয় এই হোটেল। প্রথমে চারতলা ছিল। তারপর সেই হোটেলের উপরে আরও দু’তলা বাড়ানো হয়। প্রশ্ন কলকাতা পুরসভার নাকের ডগায় এই হোটেলের নির্মাণকাজ বা হোটেল ব্যব্যসায় নিশ্চয় পুরসভার অনুমোদন ছিল?

স্থানীয় বাসিন্দারা কিন্তু বলছেন না, গত কয়েক বছরে হোটেলে বেশ কিছু অংশ পুরসভার অনুমোদন ছাড়াই সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তিন মাস আগে হোটেলের দোতলায় পানশালা তৈরির কাজ শুরু হয়, আশেপাশে স্কুল, ধর্মশালা, মন্দির ইত্যাদি থাকায় স্থানীয় মানুষ আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু হোটেলের মালিক তা ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। এ বিষয়ে পুরসভা নিশ্চয় অবগত, তাহলে কিভাবে পানশালা হল? স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পানশালা তৈরি করতে গিয়ে দোতলার যাবতীয় জানালা এবং দরজা ভেঙে সেখানে ইটের গাঁথনি করা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে? স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, টাকার জোরে এই হোটেলে একের পর এক বেআইনি সম্প্রসারণ হয়েছে। পুরসভা থেকে দমকল, পুলিশ, আবগারি সবাই এই হোটেলের বেআইনি কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু সব মহল মুখে কুলুপ এটে ছিল টাকার কারণে। সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন অনৈতিক কাজ করে চালিয়েছে হোটেলের মালিক।

অন্যদিকে পুরসাভার অভিযোগ, আপদকালীন অবস্থার কথা মাথায় রেখে দোতলা থেকে বের হওয়ার একটি রাস্তা ছিল। সেখানেও ইটের গাঁথনি দেওয়া হয়েছে। নির্মাণ সামগ্রী স্তূপাকার করে রাখা ভিতর দিক থেকে এমার্জেন্সি বা আপদকালীন দরজার সামনে। যে দরজা খোলা থাকলে এই প্রাণহানির ঘটনা অনেকটাই এড়ানো যেত বলে মত। ওই হোটেলের ছাদের উপরে প্রায় চার থেকে পাঁচটি বেআইনিভাবে ঘর তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, হোটেলের ভিতরে এক একটি ঘরের পরিধি বাড়ানো হয়েছে তাও কোনরকম অনুমোদিত নকশা ছাড়াই। দমকলের অভিযোগ, অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র কার্যত অকেজো ছিল। যদিও অনেক অগ্নি নির্বাপন সিলিন্ডার উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু সবই প্রায় মেয়াদ উত্তীর্ণ। অর্থাৎ হোটেলটিতে দীর্ঘদিন ফায়ার অডিট হয়নি। ফায়ার স্প্রিংকলার বেশ কয়েকটি অংশে ছিলই না। কেন ছিল না আর কেনই বা তা প্রশাসনের নজরে এল না? স্থানীয় মানুষের বক্তব্য সব মহল সব কিছু জানতো কিন্তু হোটেল মালিক টাকার জোড়ে হোটেলে বেআইনি অংশ নির্মাণ থেকে শুরু করে হোটেল ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রে আইন বহির্ভুত ব্যবসা চালাচ্ছিল।

প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে প্রশাসন কি করছিল? মেয়র যে বারবার দাবি করেন, বেআইনি নির্মাণ রুখতে ইঞ্জিনিয়ররা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। নাকেড় ডগা দিয়ে নজর এড়িয়ে গেল কিভাবে? রাজনীতি নাকি টাকা, কি কারণে বিশেষ ছাড় পাচ্ছিলেন ওই হোটেলের মালিক? হোটেল ভবনে ৪৭টি ঘর, যার কোনোটাতেই প্রায় জানালা নেই। তার কারণেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে যায় ভিতরে থাকা আবাসিকদের। গত নভেম্বর মাসেই ‘পোস্তা মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী পোস্তা এবং বড়বাজার অঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বিপদ এড়ানোর জন্য প্রশাসনের কড়া মনোভাবও স্পষ্ট করেছিলেন। কিন্তু তারপরও নন্দরাম, বাগরি মার্কেটের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল মঙ্গলবার মেছুয়া বাজারের ঋতুরাজ হোটেলে। কেন বারবার পুরসভা, লালবাজারের নাকের ডগায় এমন অব্যবস্থা, বেনিয়ম? ‘৩ বছর আগে হোটেল কর্তৃপক্ষ শেষবার দমকলের NOC নিয়েছিল’, কীভাবে এতদিন দমকলের NOC ছাড়াই হোটেল চলছিল? কীভাবে স্কুলের সামনে পানশালা, ডান্স ফ্লোর তৈরি হয় এবং ছাড়পত্র ছাড়াই তা চলছিল? বার ও ডান্স ফ্লোরের জন্য কীভাবে হোটেলের দ্বিতীয় সিঁড়ি রাখা হয়? ঢিল ছোড়া দূরত্বে বসে থাকা লালবাজার আর পুরসভা, যাদের সৌজন্যে ২০১০ সালের পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট এবং ২০১১ সালের ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ স্মৃতি আবার ফিরে এল, গ্যাসচেম্বার হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে এই মৃত্যুমিছিলের দায় পুরোপুরি যে তাদের এতে কারও কোনো দ্বিমত নেই।
