বহুতলের ভীড়ে যেভাবে আকাশ ঢাকা পড়েছে তাতে আড়া, ছয়দশ, পেটকাঠি, চাঁদিয়াল, মোমবাতিরা আর নিজেদের মতো করে উড়তে পারেনা। স্কুলের রুটিন, সিলেবাসের চাপ, সকাল সন্ধে টিউশান, এছাড়া কম্পিউটার, ক্রিকেট কোচিং, সাতার, জুডো-ক্যারাটে ইত্যাদির পর লাটাইতে গোটানো মাঞ্জা সুতোয় বাঁধা চৌরঙ্গী, চাপরাসরা যে চেত্তা খেতে খেতে উড়ে যাবে তার অবকাশ কোথায়! তাই নিশিত করেই বলা যায় যে এখন আর ঢিলা-ভলকা-টাইট-খিঁচ-গদ্দা এসব প্যাচে ভোকাট্টা খেলা হয়না। টাংকিবাহার কিংবা লাটাইগোরির চলও লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

আগেকার সেইসব মাঞ্জাবিদরাও নেই যারা আবহাওয়া বুঝে শান দেওয়া মাঞ্জার প্রেসক্রিপশন দেবেন। উত্তর বা মধ্য কলকাতার ছাদে ঘুড়িয়ালদের মস্তানিও আর দেখা যায় না। উন্মাদনা একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে, নেই মূল বা ধুতি বাঁশ থেকে বানানো বুক ও কাঁধকাঠির তৈরিআধা, সোয়া, একতের রমরমা। তবে আকাশে যে ঘুড়ি ওড়ে না তাও নয়, দু’চারখানা গোত্তা খায়, চিনে মাঞ্জার সুতোয় বাধা বেরঙিন ঘুড়ি, বেসুরো ভোকাট্টা ধ্বনি…

এই ঘুড়ি প্রথম উড়েছিল চিনের আকাশে খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকে; চৈনিক দার্শনিক মোজি বা মোদি এবং লুবাংবা গংশুমানের সময়ে। ভীষণ ঝড়ে গাছের পাতা উড়তে উড়তে বহুদূর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে…এমন একটা দৃশ্য দেখেই নাকি তাদের মাথায় ঘুড়ির কল্পনা খেলেছিল। এরপর যেসব ঘুড়ি আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা হয় সবগুলিই ছিল গাছের বিভিন্ন আকারের পাতা। এর অনেক পরে আসে কাগজের ঘুড়ি। মোটামুটিভাবে কাগজের ঘুড়ির প্রচলন হয় আনুমানিক ৫৪৯ খ্রিস্টাব্দে।

ঘুড়ির জন্মকথা নিয়ে দেশে বিদেশে নানা গপ্পকথা প্রচলিত আছে। তবে প্রাচীন এবং মধ্য যুগে চিন দেশে ঘুড়ি ওড়ানো হত দূরত্ব পরিমাপ করতে, বাতাসের গতিপ্রকৃতি আন্দাজ করতে, সঙ্কেত আদান প্রদান, সামরিক কার্যকলাপের যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি কাজে। আরও কয়েকটি দেশে ঘুড়ি ওড়ানো হত বিপদ সঙ্কেত জানাতে, বন্দি মুক্তি করা হচ্ছে ইত্যাদি বার্তা পাঠাতে।

এমন কথাও ইতিহাসে নাকি আছে, শত্রুশিবিরের দূরত্ব আন্দাজ করতে হান রাজবংশের রাজত্বকালে হিউয়েন সাং নিজে ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। সেই সময়কার চিন দেশের ঘুড়িগুলি ছিল আড়াআড়ি, আকৃতিগতভাবে আয়তক্ষেত্রাকার এবং একটি লম্বা লেজ তার থাকতই। পরবর্তীকালে সেই ঘুড়ির লেজটি যেমন খসে পড়ে তেমনই আয়তক্ষেত্রাকার আকারেরও বেশ খানিকটা বদল ঘটে। এই সময়ে চিন দেশের ঘুড়িগুলিতে পৌরাণিক দেবদেবী, ধর্মীয় নানা সংকেত, অংকন, অলংকরণ ইত্যাদি ছবি লক্ষ্য করা যায়। বেশ কিছু ঘুড়িতে আবার এমন একটি জিনিস আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হত যে বাতাস লেগে সেটি বাঁশির মতো বাজত।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশের আকাশেই ঘুড়ি ওড়ে তবে এশিয়ার দেশগুলিতে বেশি। নানা রঙের ঘুড়ি যেমন দেশ বিদেশের আকাশে ওড়ে তেমনই সেইসব ঘুড়ি নিয়ে রয়েছে প্রচুর বিশ্বাস, রীতি-নীতি। যেমন থাইল্যান্ডের মানুষ ঘুড়ি উড়িয়ে আরাধ্য দেবতার কাছে প্রার্থনা জানায় যাতে সময় মতো বৃষ্টি হয় এবং ফসল ভাল হয়। কোরিয়ায় যে পরিবারে শিশু জন্মগ্রহণ করল তাদের পরিবার থেকে ঘুড়ি উড়িয়ে সুতো কেটে দেওয়া হয় এই বিশ্বাস নিয়ে যে ঘুড়িটি উড়তে উড়তে যতদূর চলে যাবে ততই শিশুটির জীবনের অশুভ দূর হয়ে যাবে। এরকম প্রায় সব দেশেই আছে।

এ দেশে কবে কোথায় প্রথম ঘুড়ি উড়েছিল তা সঠিক করে বলা মুশকিল। রাজা-বাদশা-আমীর-ওমরাহদের জমানায় যেমন ঘুড়ি উড়ত তেমনি চল ছিল নবাবী আমলেও। গপ্পকথায় মেলে মাথার টুপি হাওয়ায় উড়ে যেতে দেখেই ঘুড়ি ওড়ানোর ভাবনা এসেছিল। পণ্ডিতদের কথা, ১৫৫২-র ভারতীয় সাহিত্যে ঘুড়ির সমার্থক একটি শব্দ পতঙ্গ-এর উল্লেখ রয়েছে। এমনকি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে  মাঞ্জা শব্দটিরও উল্লেখ মেলে। তবে সেটি অন্যের ঘুড়ি ভোকাট্টা করার জন্য সুতোকে যেভাবে ধারালো করা হয় সেটি-ই কিনা তার উত্তর পাওয়া যায় না।

পৃথিবীতে মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তনের মতো ঘুড়িরও বিবর্তন হয়েছে। ভারতবর্ষে আসা দুই চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন এবং হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় মেলে যে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হূণ সাম্রাজ্যের সেনাপতি হানসিন প্রায় হাজার দুয়েক লন্ঠন জ্বালানো কাঠের ঘুড়ি শত্রুপক্ষের আকাশ দিয়ে উড়িয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়ির গায়ে থার্মোমিটার লাগিয়ে বিভিন্ন উচ্চতার তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছিলেন। এর ঠিক পরের বছরই বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে প্রমান করে ফেলেন  বজ্রপাত এক ধরণের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ। লরেন্স হারগ্রেভ যে বক্স কাইটের পরিকল্পনা করেছিলেন বলা যায় সেখান থেকে রাইট ভাইয়েরা এরোপ্লেনের ভাবনা ভেবেছিলেন। আকাশে ওড়া ঘুড়ির থেকেই একে একে হ্যাংগ্লাইডিং, কাইট এরিয়াল ফোটোগ্রাফি, কাইট সারফিং, কাইট ল্যান্ড বোরডিং...
Share.

4 Comments

  1. ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিলেন। লাটাই আছে, কাঁচ গুড়ো করে মাঞ্জা কিম্বা একতে, দোতে ঘুড়ি কি এখন কেই ওড়ায়? আকাশে উড়তে দেখিনা। ঘুড়িও তো কাগজের হয়না, চীনে মাঞ্জায় দুর্ঘটনা ঘটে।

  2. বাংলার কোথাও কোথাও পৌষসংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়াবার চল থাকলেও সাধারণত বিশ্বকর্মা পুজোতেই ঘুড়ি ওড়ান হয়। আজকাল ঘুড়ি তৈরি হয় সেলোফেন কাগজে, তাতে ছাপা থাকে বার্বি গার্ল থেকে ছোটা ভীম, হনুমান, ডোরেমন ইত্যাদি। ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তর পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যে পৌষ সংক্রান্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘুড়ি ওড়ান। এদিকে ঘুড়ির উৎসবে বিশ্বকর্মা পুজো -বাঙালির আরেক ঐতিহ্য।

  3. শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের ঘুড়ি উড়িয়ে আমোদ করার কথা লিখেছেন। শোনা যায়, উনবিংশ শতকে কলকাতার বাবু সমাজের বাবুরা মাঞ্জাহীন সুতো দিয়ে ঘুড়ি ওড়াতেন। কলকাতায় আজ যে ঘুড়ি ওড়ে তা ওয়াজেদ আলির
    দান।

  4. partha banerjee on

    দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর-কালীঘাট অঞ্চলে আমার ছেলেবেলায় প্রচুর ঘুড়ি উড়ত। এখন যেখানে থাকি, দক্ষিণের শহরতলী, সেখানে কম হলেও এখনো নিয়মিত ঘুড়ি ওড়ে। আজ বিশ্বকর্মা পুজো। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। মন খারাপ। সূর্য কখন ওঠে, কখন অনুকূল হাওয়া দেয়, অপেক্ষায় আছি।…

Leave A Reply

Exit mobile version