সঞ্জীব মিত্র

চিত্রশিল্পী, পুতুল নির্মাতা, ঝাড়গ্রাম আর্ট আকাডেমির কর্ণধার

১৯৮৮ সাল ডিসেম্বর মাস জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। বছর ঊনিশের এক যুবক, নাম? সেটা নাই বা বললাম। শীতের ঠিক-ঠাক পোশাক নেই। দিন রাত ঘুরে বেড়ায় কাজের সন্ধানে। টাকার দরকার, বাড়িতে অভাব। মা বলেছেন, “আর পড়তে হবে না, সংসারের হাল ধর, আমি একা এতগুলো মানুষের পেট চালাবো কী করে? জঙ্গলে যাও কাঠ কুড়াতে। ঘরের জ্বালানির তো কিছুটা সুরাহা হবে।”
জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট শহর। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কাঠ কুড়ায় আর গাছের ডালপালাগুলি দেখে। কোনওটা সাপের মতো দেখতে, কোনওটা আবার পাখির মতো। কোনও কাঠের টুকরো আবার একটু আধটু কেটে দিলেই বিভিন্ন রকম জন্তু-জানোয়ারের রূপ নিয়ে নেয়। আনন্দে মেতে ওঠে সে। বাড়ি এসে স্লেট পেন্সিল নিয়ে বসে পড়ে। কাঠটাতে কী রূপ দেবে তার ছবি আঁকে। দুদিনে দুই বন্ধু জুটে যায়, স্লেট ও গাছের ডাল। এদের নিয়েই তার দিন-রাত কেটে যায়, একদিন হঠাৎ বিপদ। হাত থেকে পড়ে স্লেটটি ভেঙে যায়। মা চিৎকার করে, “কী হল! কী হল! একি! ঘরের ভিতর এত গাছের ডালপালা কেন? এগুলো রান্নাঘরে রেখে আয় আগুন জ্বালব।” “ না মা, এগুলো ভালো করে দেখ!” মা দেখে আর কাঁদে, ছেলেটি স্লেটের টুকরোগুলি জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করে, আর কী যেন ভাবতে থাকে। স্লেটের টুকরোগুলি জুড়তে জুড়তে অবাক হয়ে যায়।”
“কচি ভাই কচি ভাই বাড়ি আছ না কি?” দরজা খুলে অবাক, এ যে গান দাদা। “বসো বসো, এই প্রথম আমাদের বাড়ি এলে। মা চা করো, গান দাদা এসেছে। বল দাদা, আমি কি করতে পারি তোমার জন্য?” “কাল কোলকাতা যা কিছু ক্যাসেট আনতে হবে আমার দোকানে বিক্রির জন্য। তুইও কিছু টাকা পাবি।” টাকা, কাজ, স্লেট ভাঙা, গাছের ডাল— চোখ জলে ভরে ওঠে, এত কি একসঙ্গে পাওয়া যায়!
জঙ্গল ছাড়িয়ে ট্রেন চলল কলকাতায়। কত লোক, কত গাড়ি, কত ক্যাসেট, আনন্দে মনটা নেচে উঠল। সুযোগ এল আইটিআই পড়ার। পড়া, মাঝে মাঝে কলকাতায় যাওয়া আসা, বছর ঘুরে আবার শীত এল।
ট্রেনে যেতে যেতে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। ‘ স্টিল এক্সপ্রেস ট্রেন টানা হাওড়া যায়, মাঝে খড়গপুরে থামে, কয়েকজন গেটের দরজা বন্ধ করে আমরা চট বিছিয়ে নিচে বসতাম। যাতায়াতে পাঁচ ঘণ্টা ট্রেনে থাকা, ট্রেনটাও আমার বন্ধু হয়ে গেল। আইটিআই পাশ করে চাকরিতে ডাক পেলাম আম্বালায়। মা যেতে দিলেন না, অতদূর। খুব রাগ হল।
ট্রেনে বসে বসে স্লেট কেটে কেটে ছবি বানাই– নেতাজি, বিবেকাননন্দ, বিদ্যাসাগরের। ট্রেনে একবার এক বাচ্চা তাঁর বাবাকে জিগ্যেস করে, “এই কাকুটা স্লেট দিয়ে কী করছে বাবা? ” বাবার উত্তর, “ছোটবেলায় মন দিয়ে পড়েনি, তাই এখন মাটিতে বসে ভাঙা স্লেট কাটছে।”
একবার শীতে প্রচুর ঠান্ডা পড়েছে, ট্রেনের সবাই চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। রাত ৮টা, ট্রেনের ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে থমকে দাড়াই, একি দেখলাম। চিৎকার করে সবার কাছে চাইলাম, কেউ একটা চাদর দিল না। ছোট্ট মেয়েটা শীতে কাঁপছে।’ “দয়া দেখাতে হলে নিজের চাদরটাই দিন।” কেউ বলে উঠল। “দাদা তোমার চাদরটা দিয়ে দিলে? তোমার ঠান্ডা লাগবে যে।” ট্রেন থামল। কুয়াশা ভরা স্টেশন, কিছু দেখা যায় না। দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশী আর মাদলের সুর।
ঘুম আসে না, পেন হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করে তার রোজকার ট্রেনের যাওয়া আসার ঘটনা। সে এখন কবি, কত তার কবিতার বই। ট্রেন ছুটে চলে, হুইসেল বাজিয়ে, জীবন ছুটে চলে অভিজ্ঞতা নিয়ে। আবার একদিন ট্রেনে খুব চেঁচামিচি। এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক বুকে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছেন। পরের স্টেশনে চেন টেনে ভদ্রলোককে স্টেশান মাস্টারের হাতে দিয়ে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেন চলে যায়, ভর্তির ব্যবস্থা করে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরে সে। সেদিন কোনও উপার্জন হয় না। কিন্তু অর্জন হয় একটা কবিতা।
বিয়ে হল, ছেলে হল, ট্রেনও হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলল। আবার একদিন ট্রেনে মেয়ের কান্না, সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। “আরে এ কী! এ তো ‘মা’ হওয়ার যন্ত্রণা।” যাত্রীদের কাছ থেকে শাড়ি জোগাড় করে জায়গাটি ঘিরে দেয়। ট্রেনে একজন ডাক্তারও পাওয়া যায়। মা ছেলের জন্ম দেয়। নিজের ছেলের মুখটা ভেসে ওঠে। কলকাতা থেকে ঝুনঝুনি কিনে বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফেরে, অনেকটা যুদ্ধজয়ের মতো।
গরমকালে ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ গন্ডগোল। এক ভদ্রলোক পিছনে এসে লুকানোর চেষ্টা করেন। “ভাই আমাকে বাঁচাও।” গন্ডগোল থামল। ভদ্রলোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। উনি চাকরি দিলেন কলকাতায়। ট্রেনে রোজ যাওয়া আসা শুরু হল।
দিন যায়, বছর যায়, বয়স বাড়ে। বাড়ে ট্রেনের অভিজ্ঞতাও। লেখা হয় ২৮ বছরের ট্রেনের যাতায়াতের কাহিনি। এখন বাড়ি হয়েছে, গাড়ি হয়েছে, ছেলে নাটক নিয়ে পড়ছে। মায়ের বয়স বেড়েছে, এখন ওঁরা খুব আনন্দে আছে।
অনেক বন্ধুর মধ্যে এক বন্ধু তাকে ডেকে নেয়, তার প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য। ট্রেনের নিত্যযাত্রা শেষ হয়। শুরু হয় ল্যাবরেটরির কাজের সঙ্গে সঙ্গে কাঠ, স্লেটের কাজ আর কবিতা লেখা। তৈরি হয় বাড়ির ছাদে আর্ট স্টুডিও, ‘স্বপ্ন উড়ান’। আমি ওর লেখা ডায়েরিটা চুরি করে এনেছি। অনেক লেখা ২৮ বছরের ট্রেনের যাতায়াতের গল্প। গল্প নয়, সত্যি ঘটনা।
আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ রইল ‘স্বপ্ন উড়ানে’।

ঠিকানা- সুবীর বিশ্বাস (কচি)
ঘোড়াধরা, ঝাড়গ্রাম (স্টেশনের সামনে)

Share.

3 Comments

  1. হায়দার আলি। on

    কষ্ট, দারিদ্র, যন্ত্রণা থেকে যে শিল্প জারিত হয় তার থেকে পবিত্র শিল্প আর কিছু হয় বলে আমার জানা নেই। আমি সুবীর গত প্রায় ২৫ বছর ধরে দেখছি। ওর প্রতিষ্ঠা দেখে আজ বুক ভরে ঊঠে। ওর সততা আর হার না মানা মনোভাব কে পাথেয় করে আজ এই জায়গায় সে উপনীত হয়েছে। পাশে পেয়েছে আমার দেখা গুটিকয় প্রকৃত মনুষ্য পদবাচ্যের অন্যতম ওর গুরু আমাদের সকলের প্রাণের মানুষ সঞ্জুদাকে ( আর্ট একাডেমির সঞ্জীব মিত্র) । ও আরো সফল ও সৃজনশীল হোক এই কামনা করি।

Leave A Reply

Exit mobile version