বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়, নিবন্ধকার

১৯৬০ সাল। ২৪ বছরের এক যুবতী দুই বছরের শিশু পুত্রকে নিয়ে বিধবা হয়ে পড়লেন। থাকতেন কৃষ্ণনগরে এক একান্নবর্তী পরিবারে। স্বামী কাজ করতেন এনএফ রেলওয়ের সদর দপ্তর গুয়াহাটির মালিগাঁওতে। রেল কর্তৃপক্ষ ওই যুবতীকে চাকরির অফার দিলেন ওই মালিগাঁও অফিসে। কিন্তু দুই বছরের শিশু পুত্রকে নিয়ে অতদূর যেতে ভরসা পেলেন না। ম্যাট্রিক পাশ ছিলো তাঁর। শুরু হলো এক কঠিন জীবন সংগ্রাম। শুভানুধ্যায়ীদের প্রচেষ্টায় চাকরি পেলেন কৃষ্ণনগর লেডি কারমাইকেল স্কুলে প্রাথমিক বিভাগে। একদিকে শিশুপুত্রকে বড় করে তোলা অন্যদিকে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই…চাকরি, সংসার সব সামলে। কৃষ্ণনগরে সিনিয়র ট্রেনিং কলেজ পাশ করার পর প্রাইভেটে প্রি-ইউনিভার্সিটি, বিএ পরীক্ষা পাশ করলেন। এমএ পড়ার প্রবল ইচ্ছে ত্যাগ করলেন সন্তানের শিক্ষার স্বার্থে। শ্বশুরভিটের পাশের জমি নিজের যৎসামান্য সম্বল ও পরিচিতদের কাছ থেকে ধার করে শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে কিনলেন । টিউশনির সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন। সকালে স্কুল, সাংসারিক কাজ, সন্তানের পড়াশোনা সব সামলে। অমানুষিক পরিশ্রম ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা।


থেমে থাকলেন না। ১৯৭৩ সালে নিজের যা কিছু সম্বল এবং পরিচিতদের কাছ থেকে ধার করে নিজের একমাত্র দাদার সহযোগিতায় একটি একতলা বাড়ি করলেন । প্রসঙ্গত, আগের সব ধার ততদিনে শোধ। সেই বাড়ি ভাড়া দিয়ে সব ধার আস্তে আস্তে শোধ করলেন। স্কুলে সহকর্মীদের কাছে, ছাত্রীদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টস বা শিক্ষামূলক ভ্রমণে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্যা । ঠিক তেমনই আত্মীয় স্বজন, কৃষ্ণনগর এর মানুষ তাঁকে ভালবাসতেন অসম্ভব কর্তব্যপরায়ণতার জন্য। নিজের একমাত্র সন্তান পেশাগত কারণে কোনওদিন কৃষ্ণনগরে থাকতে পারবে না বুঝতে পেরে অত কষ্ট করে তৈরি করা সাধের বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় ফ্ল্যাট বুক করলেন। নিজের দিকে কোনদিন তাকান নি। যাবতীয় ত্যাগ একমাত্র সন্তানের জন্য। অল্পেই খুশি থাকতেন, প্রাণখোলা হাসির অধিকারী ছিলেন।


স্বামীজির বাড়ি সংস্কার হচ্ছে। পেনশনের সামান্য টাকা সেই মহান কাজের জন্য নিবেদিত করলেন। নীরবে সাহায্য করতেন দুঃস্থ আত্মীয় স্বজন ও গরীব দুঃখীদের। ভালো গাইতেন, আঁকতেন, হাতের কাজ-সেলাই ছিল অসামান্য। রান্না, পিঠেপুলি তৈরিতে তাকলাগানো। প্রতিটি কাজে থাকতো যত্নের ছোঁয়া। বেলুড় মঠের প্রবীণ – নবীন সন্ন্যাসীরা তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরাও। অসম্ভব পড়ুয়া ছিলেন। শেষ দিকে চোখের সমস্যার জন্য পড়তে পারতেন না বলে অসম্ভব কষ্ট পেতেন।
দৃঢ়চেতা সেই তরুণীটির নাম আভা মুখোপাধ্যায়। ২০১৮ সালে ১১ মার্চ, ৮১ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
আমার মাকে অন্তরের যাবতীয় শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version