যদিও খাতায় কলমে দেশের কোথাও গণ-আন্দোলনের কারণে সভা-সমতি-মিছিল করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু বারবারই ক্ষমতাসীন সব দলের সরকার যে কোনও আন্দোলনের উপরই নানা ধরনের বাঁধা নামিয়ে আনার ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ এবং ‘৬৯ সালে এ রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলেও গণআন্দোলনে পুলিশ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে দাবি উঠেছিল। কিন্তু সিপিএম-সিপিআই সেদিন সেই দাবি মানতে চায়নি। পরবর্তীতে কংগ্রেস সরকার এবং ১৯৭৭-এ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর সিপিআইএম সরকারও গণ-আন্দোলনের উপর পুলিশি দমন নীতির নির্মম প্রয়োগ করেছে।

১৯৮৩ সালের বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে কলকাতার মানিকতলায় পুলিশের গুলি লেগে দুলাল দাস মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরও পুলিশ তাকে লাথি মারতে মারতে রাস্তা দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ভ্যানে তুলেছিল। ১৯৯০ সালের বাসভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুলিশ কলকাতা এবং পুরুলিয়াতে গুলি চালায়। ওই বছর ৩১ আগস্ট ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবসে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন ১৮ বছরের তরুণ মাধাই হালদার। সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসু বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘নিরামিষ আন্দোলনকে একটু আমিষ করে দেওয়া হল’

পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুলি চালনা জনমানসে বহু প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশের জন্য আদৌ কি কোনও আইন আছে? কোনও মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার নামে পুলিশ কি তরতাজা প্রাণ মাটিতে লুটিয়ে দিতে পারে? পুলিশ মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক কর্মীদের ফাঁসিয়ে গ্রেপ্তার তারপর অত্যাচার কবে বন্ধ করবে? আন্দোলন মোকাবিলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই প্রশ্নগুলি বছরের পর বছর ধরে উঠলেও উত্তর মেলেনি।

তাই ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই ( 21st July )কলকাতায় যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানের মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যুর পরও প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু অভিযান মোটেই গণতান্ত্রিক ছিল না বলে দাবি করেন। এই জ্যোতিবাবুই কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপরে পুলিশ গুলি চালাবে না, বামপন্থী সরকারের এই নীতির কথা বলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সে দিনের আন্দোলনকে ‘সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে মন্তব্য করেন বুদ্ধবাবু তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, “সে দিন পথ তো দখল হয়েই গিয়েছিল! তার উপরে গায়ের জোরে মহাকরণ দখল করার চেষ্টা হয়েছিল! গণতন্ত্রে এটা কখনও হতে পারে!” ঘটনার দিন ৭০-৮০ জন পুলিশকর্মী জখম হন বলেও সে দিন দাবি করেন বুদ্ধবাবু। যে কোনও মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেও সেদিন তদন্ত কমিশনের সামনে বুদ্ধবাবু বলেন, সে দিন মহাকরণ অভিযানকে কেন্দ্র করে বড় আকারের হিংসা ছড়িয়েছিল কলকাতায়। গুলিচালনা এড়াতে পারেনি পুলিশ। তিনি মনে করিয়ে দেন, পুলিশের সেদিনকার রিপোর্টেও বলা হয়, পরিস্থিতির মোকাবিলায় পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের (21st July ) ঘটনা নিয়ে বিধানসভায় তৎকালীন বাম সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বিধায়ক সৌগত রায়। অন্তত এক জন আহত পুলিশকে বিধানসভায় হাজির করতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু এক জন আহত পুলিশকেও সরকার উপস্থিত করতে পারেনি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও বলেন, “সে দিন যে আন্দোলন হয়েছিল, তা পুলিশের অনুমতি নিয়েই। আর মহাকরণে একটা ইট লাগা তো দূরে থাক, নখের আঁচড়ও পড়েনি! সেই কারণে বুদ্ধবাবু গুলিচালনার যে সাফাই গেয়েছেন, তার যুক্তি ধোপে টেকে না!”

মেয়ো রোড ও ডোরিনা ক্রসিং তো মহাকরণ থেকে অনেক দূরে। তা হলে মহাকরণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এই আশঙ্কায় পুলিশ ওখানে গুলি চালাল কেন? বুদ্ধবাবু জানান, “কোন জায়গায়, কত দূরে জনতাকে থামাতে হবে, তা ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশই ঠিক করে। হাতে-কলমে কাজ করে তারাই।”

এক সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে পুলিশ কোডে লেখা হয়েছিল মিছিলকারীদের উপর বলপ্রয়োগ যদি করতেও হয়, সে ক্ষেত্রে পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করবে, না হলে খালি হাতেই ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। না পারলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ নিয়ে যদি আঘাত করতেই হয়, তবে তা পায়ের নিচের অংশে করতে হবে। আঘাত যাতে কোনও মতেই জীবনঘাতী না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে, ইত্যাদি।

গণতন্ত্রের মুখোশ বজায় রাখতে পুলিশের আচরণবিধিতে লেখা হয়েছে অনেক কথাই, কিন্তু তা মেনে চলতে পুলিশকে বাধ্য করবে কে? সরকার। কিন্তু এর জন্য শাসকদের যে জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন তা কি সেদিনের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের ছিল? তাহলে মানিকতলায় কিংবা রেড রোডে আন্দোলনকারীরা মাটিতে পড়ে যাবার পরেও একাধিক পুলিশ কর্মী মিলে পেটানো এবং গুলি করে মারার ঘটনা ঘটলো কেন? পরবর্তীতে বামফ্রন্টের গণআন্দোলনের উপর বাম ফ্রন্টের পুলিশের ওটাই ‘স্বাভাবিক’ ছন্দ হয়ে ওঠে। মুখে গালাগালির বন্যা বইয়ে পুলিশকর্মীরা যে নৃশংস ভঙ্গিতে আন্দোলনকারীদের দিকে তেড়ে যাওয়া শুরু করে, তা দেখে কোনও দুষ্কৃতীবাহিনীর থেকে তাদের আলাদা করা মুশকিল হত। মহিলা আন্দোলনকারীদের মহিলা পুলিশ দিয়েই গ্রেপ্তার করার রীতি তখন থেকে পুলিশ প্রায় তুলে দিল। আন্দোলনকারীদের মাথা, চোখ বারবার পুলিশের মারের লক্ষ্য হয়ে উঠল। বাম জমানায় পুলিশের মারে মিছিলকারীদের চোখ নষ্ট হওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে। পুলিশ কিংবা রাজ্য সরকার তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া দূরে থাক, এতটুকু দুঃখপ্রকাশও করেনি।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version